আফগানিস্তানে তালেবান, ভারতে বাড়ছে ইসলামোফোবিয়া

| আপডেট :  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৪  | প্রকাশিত :  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০৪

আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের পুনরায় নেয়ার পর থেকে ভারতে নতুন করে বাড়ছে ইসলামোফোবিয়া। আফগান তালেবানের পুনরুত্থানের পর ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নতুন করে ঘৃণামূলক অপরাধের মাত্রা বেড়েছে।

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সহ দেশটির উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিসমূহের ঘৃণামূলক প্রচারাভিযানের শিকারে পরিণত হয়েছেন মুসলিম রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বসহ সাধারণ ভারতীয় মুসলমানরা।

গত মাসে তালেবান আফগানিস্তানে পশ্চিমা মদদপুষ্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুৎ করার পরপরই ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগে আফগানিস্তানে চলে যাও (#GoToAfghanistan) প্রচারণার ঝড় বয়ে যায়। হ্যাশট্যাগে পাকিস্তান চলে যাও (#GoToPakistan) প্রচারণার মতোই ভারতকে নৃতাত্ত্বিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাওয়া উগ্র রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো এই প্রচারণা শুরু করে।

ভারতীয় কমি ও মানবাধিকার কর্মী হুসাইন হায়দরি সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেন, ‘বিজেপিপন্থী বা বিজেপিবিরোধী উভয় ধারার
লোকেরাই তালেবান বা তালেবানি শব্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই শব্দ ব্যবহার করছে।’

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি বা জিহাদি বা আতঙ্কবাদী (সন্ত্রাসী) শব্দের মতোই মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসার জন্য এই শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।’

তালেবানের কাবুলে প্রবেশে অল্প কিছুদিন পরেই এক সভায় বিজেপি নেতা রাম মাধব ১৯২১ সালের ব্রিটিশবিরোধী মোপালা বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম ‘তালেবানি মনোভাবের’ আন্দোলন হিসেবে মন্তব্য করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালার রাজ্য সরকার এই ঘটনাটিকে ‘রাখঢাক’ করে প্রচারের চেষ্টা করছে।

অপর এক ঘটনায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম খবর জানায়, মধ্যপ্রদেশের মোহররমের মিছিলে মুসলমানরা পাকিস্তানপন্থী স্লোগান তুলেছিলো।
এই খবরকে উদ্ধৃত করে বিজেপি দলীয় প্রাদেশিক মুখমন্ত্রী মন্তব্য করেন, তিনি ‘তালেবানি মনোভাব সহ্য করবেন না।’ তার মন্তব্যের দুই
দিন পরেই খবরের সত্যতা যাচাই করা ওয়েবসাইট এএলটি নিউজ জানায়, মোহররমের মিছিলে মুসলমানদের পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দেয়ার খবরটি ভুয়া ছিলো।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় আসামে এক রাজনীতিবিদ, স্থানীয় এক সাংবাদিক ও আলেমসহ মোট ১৫ জনকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালেবানকে ‘সমর্থন করার’ অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী বেআইনি কার্যক্রম (প্রতিরোধ) আইন-ইউপিএর অধীনে গ্রেফতার করা হয়। কঠোর এই আইনের অধীনে ভারতের কয়েক শ’ মুসলিম নাগরিক ও সরকারবিরোধী সমালোচকদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।

‘তালেবানের সাথে আমাদের কি কাজ?’

হায়দরি বলেন নিজেদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবিচারের বিরুদ্ধে যে মুসলমানরাই সোচ্চার বা ঘৃণামূলক অপরাধের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলছেন, তাদেরকেই তালেবানের প্রতি সহানুভূতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, যদিও তারা তালেবানের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।

লখনৌর বাসিন্দা, উর্দু ভাষার বিখ্যাত ভারতীয় কবি মুনাওয়ার রানা তালেবান ও হিন্দু ধর্মীয় মহাকাব্য রামায়নের রচয়িতা বাল্মিকীকে এক
সাথে তুলনা করে মন্তব্য করার পর হিন্দুত্ববাদী শিবিরের রোষের শিকার হয়েছেন।

দুই সপ্তাহ আগে এক টিভি বিতর্কে রানা বলেছিলেন, সময়ের সাথে সাথে মানুষের চরিত্র বদল হয়।

এর উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, রামায়ন লিখে প্রায় ‘ঈশ্বরে’ পরিণত হয় বাল্মিকী প্রথম জীবনে ছিলেন একজন ‘ডাকাত’।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে রানা জানান, তিনি কোনো ত্রুটিপূর্ণ কথা বরেননি এবং তার মুসলিম পরিচিতির কারণেই ওই সব ব্যক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছেন যারা আগামী বছর তার রাজ্য উত্তর প্রদেশের প্রাদেশিকর নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজকে বিভক্ত করতে চাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ভারতীয় বা মুসলিম হিসেবে আমরা কবেই বা কোনো সন্ত্রাসীকে সমর্থন করেছি? তালেবানের সাথে আমাদের কি কাজ? কিন্তু
যখনই বিশ্বের কোথাও কোনো বিস্ফোরণ ঘটে এবং এর সাথে জড়িত কোনো মুসলমানের নাম পাওয়া যায়, আমাদেরকে এর জন্য দায়ী করা হয়।’

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আফগানদের সংগ্রামকে ব্রিটিশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সংগ্রামের তুলনা করায়
উত্তর প্রদেশের মুসলিম রাজনীতিবিদ শফিকুর রহমান বারকের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা করা হয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এএনআই নিউজে প্রচারিত ১৭ আগস্টের এক ভিডিও ক্লিপে শফিকুর রহমান বারককে বলতে দেখা যায়, ভারতীয়রা
স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলো যখন তাদের দেশ ব্রিটিশরা দখল করে রেখেছিল।

তিনি বলেন, ‘তেমনিভাবে এখন তারা (আফগানরা) যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বে, এর আগে রাশিয়ার দখলদারিত্বে থাকার সময় স্বাধীনতা চেয়েছে এবং তাদের দেশকে মুক্ত করেছে।’

এই মন্তব্যের জেরে তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়েছে। শফিকুর রহমানের বারকের সাথে আরো দুইজনকে মামলায় যুক্ত করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মন্তব্যের অভিযোগ করা হয়।

আলজাজিরাকে বারক জানান, তার বক্তব্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের নেয়াকে সম্পূর্ণই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘সবদেশেই প্রতিনিয়ত সরকার পরিবর্তন হয়। কেনো আমরা অন্য কোথাও কি হচ্ছে তা আমাদের চিন্তায় নেবো? আমাদের
সরকারের উচিত তালেবানের শাসনকে স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়ার বিষয়ে এক নীতি নির্ধারণ করা, যা আমরা মেনে চলতে পারি।’

ভারতের ভেতরে বিজেপি নেতা ও মুখপাত্ররা যেখানে প্রতিনিয়ত তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে গালাগালি করছেন, সেখানে কাতারে দেশটির রাষ্ট্রদূত মঙ্গলবার দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক দফতরে দলটির নেতৃত্বের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন।

রানার মতোই বারক জানান, জাতীয় রাজনীতিতে উত্তর প্রদেশ গুরুত্বপূর্ণ এক রাজ্য হওয়ায় ভোটারদের প্রভাবিত করতে বিজেপি তার বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে।

এরইমধ্যে ভারতীয় মুসলিম মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিদের বিশাল একটি অংশ তালেবানের কর্মকাণ্ড ও আফগানিস্তানে দলটির ক্ষমতাগ্রহণের ফলে ভারতীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর কিছু অংশের উচ্ছাসের নিন্দা জানিয়ে আসছেন।

বারক ও রানার মন্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে রাজনৈতিক নৃতাত্ত্বিক ইরফান আহমদ বলেন, কোনো গণতান্ত্রিক ব্যক্তিই তাদের মন্তব্যে প্রতিবাদের কিছু পাবেন না। কেননা তারা বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে তালেবানের যুদ্ধকে নির্দেশ করেছেন, যেখানে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে আফগানিস্তানের মতো দারিদ্রপীড়িত দেশে ২০ বছরের দখলদারিত্ব চালানো হয়েছে এবং অব্যাহত বোমবর্ষণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘তালেবানের কাজ অনুযায়ী তাদের ততো প্রশংসাও করা হয়নি : কোনো প্রকার সহিংসতা ছাড়াই তাদের কাবুরে প্রবেশ, তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নারী শিক্ষা অব্যাহত রাখা এবং গোষ্ঠীগত সমন্বয়ে তাদের ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি।’

উত্তর প্রদেশের প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথও ভারতকে ‘তালেবানিকরনের প্রচেষ্টা’ চলছে বলে মুসলিমবিরোধী প্রচার অভিযানে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।

রাজ্যসভার এক অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে নারীদের বিরুদ্ধে অবিচার করা হচ্ছে… কিন্তু তারপরেও কিছু লোক বেহায়াভাবে তালেবানের সমর্থন করছে।’

ইতোমধ্যেই ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর জেলার দেওবন্দে সন্ত্রাসবিরোধী এক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন আদিত্যনাথ। আফগানিস্তান-পাকিস্তানে দেওবন্দের কওমি ধারার মাদরাসা থেকে তালেবানের উত্থান হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত ভারতে মুসলিমবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যেই আফগানিস্তানে তালেবানের নতুন করে উত্থানকে উপলক্ষ্য করে নতুন করে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানো হচ্ছে। সূত্র : আলজাজিরা

 

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত