সংসার ভাঙার দায় চাপানো হয় বলেই মুখ খোলে না নারীরা
দেশে তালাক পরবর্তী সময়ে নানা কারণে নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় বেশি ট্রমার মুখে পড়তে হয় বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংসার ভাঙার পুরো দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয় নারীর ওপর। একদিকে ঘর ভাঙার বেদনা, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা নারীদের মধ্যে চরম অনিরাপত্তাবোধ তৈরি করে।
তালাকের বিষয়টিকে নিজের তো বটেই, পরিবারের জন্যও অসম্মানজনক মনে করা হয়। সেসব কারণে তালাক নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখ খুলতে চান না তারা। পারলে লুকিয়ে রাখা হয় পুরো বিষয়টিকে।
যার কারণে তালাক সমাজে এক ধরণের ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে।
শেরপুরের নাসিমা, একজন পোশাক কর্মী। নাসিমা তার ছদ্ম নাম। দু’সন্তানের মা বলেন, ২০০৩ সালে তার স্বামী তাকে তালাক দেন। তবে সেটাও বেশ নাটকীয়তার মধ্য দিয়েই। কারণ এর আগে তিনি চিন্তাই করতে পারেননি যে তার স্বামী তাকে তালাক দিতে পারে।
নাসিমা বলেন, স্বামীর সাথে কোন কিছু নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না তার। স্বামীসহ বেড়াতে এসেছিলেন বাবার বাড়িতে। সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক। তারপর একদিন সকালে হঠাৎ করেই যেন বদলে যায় তার পরিচিত যাপিত জীবন।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রতি ৩৮ মিনিটে একটি করে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়েছে ঢাকা শহরে।
রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় থাকেন মাসুদা লাবনী। তিনি জানান, ১০ বছরের সংসার ভেঙে যাওয়াটাকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারতেন না।
তিনি বলেন, ‘আমার মধ্যে মেন্টাল একটা ট্রমা সবচেয়ে বেশি যেটা কাজ করতো যে, সেটা হচ্ছে বিশ্বাস। যে একটা মানুষের সাথে আমি ১০ বছর কাটালাম সে কীভাবে আমাকে ডিভোর্স দিতে পারে সেটা আমি ক্লিয়ার হতে পারছিলাম না।
তালাকের পর প্রথমদিকে তার নিজের পরিবারের সদস্যরাও মনে করতো যে, সব দোষ তার। বছর দেড়েক সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তারা কিছুটা বুঝতে শুরু করে। এখন তিনি মানসিক যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালাকের পর সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে ট্রমা বা প্রবল মানসিক আঘাতের মুখে পড়েন নারীরা।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, তালাকের পর যে মানসিক ট্রমা তৈরি হয় সেটা থেকে বের হতে অনেকের দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এটা অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে ওই ব্যক্তি মানসিকভাবে কতটা দৃঢ় তার উপর।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, পুরুষ আর নারীর উপর তালাকের প্রভাব ভিন্ন হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীদের তালাকের পর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হয়। এমনই একজন সিরাজগঞ্জের সাবিনা।
এটিও তার ছদ্ম নাম। ২০১৪ সালে তালাক হয় তার। সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিল তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন। তবে তালাকের পর নিজের আর দুই সন্তানের ভরণ-পোষণ নিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়তে হয়েছিল তাকে।
এমন অবস্থায় খরচ যোগাতে শুরু করেন দর্জির কাজ। ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটান আর্থিক অবস্থার। শুরুর লড়াইটা খুব সহজ ছিল না মিজ সাবিনার জন্য। নিত্যদিনকার আহার যোগানোটাই তখন মুখ্য ছিল তার।
তবে বিয়ে এবং তালাকের পর যাদের সন্তান থাকে এবং পরিবারের অন্য কোন সহায়তা থাকে না, সেই একাকী মা বা সিঙ্গেল মাদারদের লড়াইটা হয় আরো কঠিন। তেমন একজন সৈয়দা জিনিয়া মোমেন।
রাজধানী ঢাকার কাওরানবাজার এলাকায় সাততলার একটি ফ্ল্যাটে মেয়েকে নিয়ে একাই থাকেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার পর বিদেশি একটি সংস্থায় চাকরি করতেন। এরপর ২০১২ সালে বিয়ে হয় তার। মাত্র দু’বছর যেতে না যেতেই স্বামীর সাথে তালাক হয়।
দশ-মাস বয়সী মেয়েকে নিয়ে বাবার বাসায় থাকতে শুরু করেন তিনি। মেয়ের দেখাশুনার জন্য ছেড়ে দিতে হয় আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরিটিও। একই বছরে বাবার মৃত্যু হলে, ছোট ভাই আর মেয়েকে নিয়ে একেবারেই একা হয়ে পড়েন তিনি। কাছের আত্মীয়রাও দূরে সরে যায়।
অভিযোগের স্বরে মোমেন বলেন, স্বামী না থাকার কারণে কটূক্তি, বাজে ইঙ্গিতসহ নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।
এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ থাকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। কারণ সামাজিকভাবে লিঙ্গগত দিক থেকে পুরুষের তুলনায় নারীদেরকে কম ক্ষমতাসম্পন্ন ভাবার প্রবণতা রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, এসব এসব কারণেই পুরুষ আর নারীর ওপর তালাকের প্রভাব ভিন্ন হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সারা পৃথিবী জুড়েই তালাকের প্রভাব পুরুষের তুলনায় নারীদের ওপর বেশি পড়ে। কারণ আমরা মনে করি যে তারা নির্ভরশীল। অর্থনীতিতে ফেমিনাইজেশন অব পোভার্টি বলে একটা কনসেপ্ট আছে। নারীরা হচ্ছে দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম। যদি তারা অর্থনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে প্রভাবশালী না হন তাহলে পুরুষের তুলনায় তাদের উপর তালাকের প্রভাব নেতিবাচক হয়।’
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, নারী কিংবা পুরুষ যে কেউই তালাকের আবেদন করতে পারে।
তবে বেশিরভাগ নারীই তাদের আইনগত অধিকার নিয়ে খুব একটা সচেতন নয় বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। ভুল ধারণা রয়েছে দেনমোহর পরিশোধ নিয়েও।
এ বিষয়ে আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, তালাকের আবেদন যেই করুক না কেন, সেটি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে অন্তত তিন মাসের ভরণ-পোষণ দেয়ার বিধান রয়েছে।
মিতি সানজানা বলেন, অনেকেই মনে করে যে, তালাক হলেই দেনমোহর দিতে হবে। তারা জানে না যে, দেনমোহর আসলে তালাকের সাথে নয় বরং বিয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিয়ের সময়েই সেটা পরিশোধ করতে হয়।
তালাকপ্রাপ্ত নারীর যদি কোনো সন্তান থাকে তাহলে তার ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত ওই সন্তানের সব ধরণের ভরণ-পোষণ দিতে হবে স্বামীকে।
স্বামী যদি এই খরচ দিতে না চায় বা অসম্মতি জানায় তাহলে পারিবারিক আদালতে মামলা করার সুযোগ রয়েছে বলে জানান মিতি সানজানা।
তবে তালাক প্রাপ্ত যে নারীদের সাথে কথা হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বলেছেন, ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কা এবং হয়রানির ভয়ে আইনি সহায়তা নিতে আগ্রহী হননি তারা। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত