পশ্চিমা বিশ্বকে শক্তি দেখালেন পুতিন, ইউক্রেনের মানচিত্র বদল
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন সোমবার রাতে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অবশ্য গণভোটে ওই দুই অঞ্চলের মানুষ আগেই স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এখন পুতিন স্বীকৃতি দিয়ে এই দুই ‘প্রজাতন্ত্রে’ রুশ সেনাদের শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানি ও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার হুমকি উপেক্ষা করে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজের শক্তি দেখালেন পুতিন। এতে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে বড় যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে গেল। এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মস্কোর নিন্দা করলেও সব পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে চীন ও ভারত।
রুশ প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণার পরই জাতিসংঘের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে রাশিয়ার দূতকে তুলাধুনা করেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা। পুতিনের ঘোষণায় তীব্র নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ তাদের মিত্ররা। জাতিসংঘপ্রধান আন্তোনিও গুতেরেসও মস্কোর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কড়া প্রতিবাদ জানান।
এমন প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দেন, রাশিয়াকে মোকাবিলায় পশ্চিমারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আজই (মঙ্গলবার) নিষেধাজ্ঞা দেবে। পরে যুক্তরাজ্য রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংক ও তিন ধনকুবেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। পুতিনঘনিষ্ঠ ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, রুশ পার্লামেন্ট ডুমার ৩৫২ সদস্য ও ১১ সেনা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে গতকাল রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বাইডেন কোনো নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা দেননি।
সোমবার দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণার আগে পুতিন রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা করেন। সেখানে শীর্ষ নিরাপত্তা উপদেষ্টারা অঞ্চল দুটিকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে মত দেন। সে সময় দেশটির বৈদেশিক গোয়েন্দা প্রধান সের্গেই নারিশকিন জানান, তিনি ওই দুই অঞ্চলকে রাশিয়া ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্তিও সমর্থন করেন। পরে টেলিভিশনে দীর্ঘ ভাষণের পর দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দুটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন পুতিন।
এর আগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজকে টেলিফোন করে বিষয়টি জানানো হয় ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে। মাখোঁ একে সম্প্রতি হওয়া দুই দেশের প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। হতাশা প্রকাশ করেছেন ওলাফ। এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের ডাকা জরুরি বৈঠকে রুশ পদক্ষেপের নিন্দা জানালেও নির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়নি। এ পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানায় চীন ও ভারত।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, শিগগিরই সম্মিলিত নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসছে। দেশটির ভারপ্রাপ্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন ফিনার বলেছেন, এটি খুব দ্রুত ও তীব্র হবে। এর আগে হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জেন সাকি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পরিস্কার করেছেন যে রাশিয়া আক্রমণ করলে জার্মানিগামী গ্যাসলাইন নর্ড স্ট্রিম-২ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ‘রাশিয়া বাস্তবে কী করছে, আমরা তা পর্যালোচনা করছি। বর্তমানে রুশ সেনারা দোনবাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা নতুন কোনো পদক্ষেপ নয়। ট্যাঙ্ক অগ্রসরের আগ পর্যন্ত আমরা কূটনীতি চালিয়ে যাব।’ এদিকে, রুশ সেনা মোতায়েনকে আগ্রাসন বলতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তা। তারা বলছেন, এটি আগ্রাসন শুরুর প্রাথমিক পর্যায়। ক্রেমলিন বলেছে, সুযোগ এখনও শেষ হয়নি। আমরাও আলোচনার জন্য প্রস্তুত।
জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রিস্টিন ল্যামব্রেস বলেছেন, উত্তেজনা পরিস্থিতিতে আমরা লিথুয়ানিয়ায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত। তারপরও আমরা ইউক্রেন সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাব।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়া আগ্রাসনকারীর ভূমিকা পালন করছে। আমরা জানি না তার এই আগ্রাসন কোন পর্যন্ত যাবে। এজন্য আমাদের বিশ্বাসযোগ্য সামরিক প্রতিরোধ জরুরি।
এদিকে, রাশিয়া থেকে জার্মানি হয়ে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির জন্য স্থাপন গ্যাসলাইন নর্ড স্ট্রিম-২ এর কার্যক্রম স্থগিত করেছে বার্লিন। রাশিয়ার সর্বশেষ পদক্ষেপের কারণে ১০ বিলিয়ন ডলারের এই বৃহৎ প্রকল্প স্থগিত করে তারা। জার্মানির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
পুতিনের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল পাঁচটি রুশ ব্যাংক ও তিন ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ এবং যুক্তরাজ্যে থাকা তাদের সম্পত্তি বায়েজাপ্ত করেছে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রশাসন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটি ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞার প্রথম ধাপ।
পুতিনের সেনা পাঠানোর পর সেখানে যুদ্ধ এক প্রকার শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ। তিনি বলেন, ‘আপনি উপসংহার টেনে বলতে পারেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
এমন পরিস্থিতিতে যে কোনো সময় হামলা হতে পারে উল্লেখ করে জেলেনস্কিকে কিয়েভ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সোমবার বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপের সময় জেনেলস্কিকে এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে থাকা বেশিরভাগ দূতাবাসই পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী লেভিভ শহরে রয়েছে। সেখানে তাকে যাওয়ার কথা বলেছে ওয়াশিংটন।
গতকাল জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়া আঞ্চলিক শান্তি নষ্ট করছে। তবে আমরা শান্তি চাই। কিন্তু কোনো অবস্থায় মস্কোর কাছে আমাদের ভূমি ছাড়ব না।
পুতিনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক ঐক্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। তা অটুট রাখতে ইউক্রেনের সরকার ও জনগণের পাশে রয়েছে ওয়াশিংটন। জনসন বলেছেন, পুতিনের এমন ঘোষণা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। তাদের জনগণের পাশে থাকতে সম্ভাব্য সবকিছু করবে যুক্তরাজ্য। তবে মস্কোর পদক্ষেপকে সমর্থন দিয়েছে সিরিয়া ও নিকারাগুয়া।
এমন প্রেক্ষাপটে দিল্লি কোনো পক্ষ না নিলেও ইউক্রেনে থাকা তাদের শিক্ষার্থীদের দ্রুত সে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে ভারত। এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে আজ মস্কো যাচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরানের এটিই হবে রাশিয়ায় প্রথম সফর। খবর গার্ডিয়ান, আরটি, সিএনএন ও বিবিসির।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত