কিয়েভে প্রাণপণ লড়াই চলছে
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখলে দেশটির যোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াই চলছে রাশিয়ার সেনাদের। হামলার দ্বিতীয় দিন গতকাল শুক্রবার রাত ৯টায় এ খবর লেখা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কিভেয় শহর ঘিরে এগোচ্ছে রুশ বাহিনী। এরই মধ্যে বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। যে কোনো সময় কিয়েভের পতন হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা।
কিয়েভের যদি পতনও হয়, তারপর কী হবে- তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। পুরো বিশ্বের নজরও এখন এই যুদ্ধের ময়দানে। ইউক্রেন থেকে একটি বড় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এখনও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, বিশ্ব সম্প্রদায়ের জোরালো বিরোধিতা, দেশে দেশে হামলাবিরোধী বিক্ষোভ- কিছুতেই থামছেন না রুশ প্রেসিডেন্ট। ফলে এই হামলা বিশ্বকে কতটা ভোগাবে, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্নেষণ। খবর বিবিসি, আলজাজিরা, এএফপি, আরটি ও দ্য গার্ডিয়ানের
রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলার মুখে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার দেশের জনগণকে অস্ত্র নিয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। এরই মধ্যে গতকাল থেকে দু’পক্ষের মধ্যে কথা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ইউক্রেনীয় সেনাদের জেলেনস্কির কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে আলোচনায় বসার বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এর আগে অস্ত্র সমর্পণ করে ইউক্রেনকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। তবে তার আগে তাদের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করতে হবে। একই সঙ্গে ‘বেসামরিকীকরণ’-এর শর্তও মানতে হবে। জেলেনস্কি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরপরও আলোচনার বিষয়ে আগ্রহ দেখান ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা। তবে মিনস্ক নয়, ওয়ারশতে বসতে মস্কোকে প্রস্তাব দেন তিনি। তবে মস্কোর দাবি, আলোচনার বিষয়ে নীরব হয়ে গেছে কিয়েভ।
ফলো করুন-
জেলেনস্কি বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেছেন, ‘রাশিয়ার মূল টার্গেট আমি।’ তার এই বক্তব্যের পর পুতিন ইউক্রেনীয় সেনাদের জেলেনস্কিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জল-স্থল-আকাশে ইউক্রেনের তিন দিক থেকে রাশিয়ার হামলার দ্বিতীয় দিনে দেশেটির বেশিরভাগ শহর দখলে নিয়েছে রুশ সেনারা। তবে প্রতিরোধ যুদ্ধে ইউক্রেনের সেনারা কোথাও কোথাও তাদের পরাস্ত করেছে বলে জানা গেছে।
হামলা ও প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্যে যারা কিয়েভে আছেন, তারা আন্ডারগ্রাউন্ড, বাংকার, বাড়ির বেজমেন্ট, পাতাল রেলের স্টেশনসহ লুকিয়ে থাকা যায়- এমন সব স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। মুহুর্মুহু বোমা বিস্ফোরণ ও কামানের গোলায় কেঁপে উঠছে মাটি, আকাশে গর্জন তুলে শাঁ শাঁ করে চক্কর দিচ্ছে জঙ্গি বিমান। কিয়েভে তিনজন বেসামরিক মানুষ নিহতের তথ্য পাওয়া গেছে।
দু’পক্ষের লড়াইয়ে গতকাল পর্যন্ত বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুক্তরাজ্য দাবি করেছে, ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রতিরোধ হামলায় প্রায় ৪৫০ রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি, দু’দিনে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ যুদ্ধে রাশিয়ার দুই হাজার ৮০০ সেনা নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া তাদের ৮০টি ট্যাংক, ৫১৬টি যুদ্ধযান, ১০টি যুদ্ধবিমান ও সাতটি সামরিক হেলিকপ্টার ধ্বংস করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য বা ইউক্রেন হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির কোনো প্রমাণ দেয়নি। আর ক্রেমলিন এ বিষয়ে কোনো তথ্যই দেয়নি।
গতকাল জাতিসংঘ জানায়, রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। তাদের বেশিরভাগ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, মলদোভাসহ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজসহ পশ্চিমা নেতারা ইউক্রেনে হামলার জন্য এককভাবে পুতিনকে দায়ী করেছেন। কঠোরতম সব নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে পুতিনকে শিক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। নিষেধাজ্ঞার ঢেউ থামছে না। সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, তারা পুতিন ও ল্যাভরভের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে এবং ইউরোপে তাদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করছে।
নিষেধাজ্ঞার পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করেছে রাশিয়া। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা এরোফ্লোটকে যুক্তরাজ্য নিষিদ্ধ করায় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজকে নিষিদ্ধ করেছে মস্কো।
গত সোমবার ইউক্রেনের মস্কোপন্থি বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন। গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাশিয়ার প্রায় দুই লাখ সেনা ইউক্রেনে হামলায় অংশ নেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলো।
সামরিক সহায়তার আহ্বানে সাড়া পাননি জেলেনস্কি: একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও পশ্চিমারা ইউক্রেনে সেনা পাঠাবে না। বাইডেন পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন, ইউক্রেনে কোনো সেনা পাঠাবে না যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো প্রধানেরও একই কথা। এ নিয়ে জেলেনস্কি অসহায়ত্বের সুরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গতকাল তিনি এক ভিডিওবার্তায় বলেছেন, ইউক্রেন একাই রাশিয়াকে মোকাবিলা করছে। চরম বিপদের এই মুহূর্তে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কথা বলেও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না।
ইউক্রেন সংকট নিয়ে গতকাল প্রকাশ্যে এসেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এই সংকটের শুরু থেকে বেইজিং রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষার অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে এখন পুতিনকে সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানালেন জিনপিং। এ বিষয়ে রাশিয়াকে সহযোগিতা করারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
ইউক্রেনে রুশ হামলায় সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর করিম খান। এ দিকে ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হওয়ার পর ইউরোপের আকাশপথে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ঝুঁকি এড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্সগুলো ইউক্রেনের আকাশসীমা এড়িয়ে চলছে।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত