অপ্রতিরোধ্য কলসিন্দিরের ফুটবল কন্যারা এবার একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে
ময়মনসিংহ করেস পন্ডেন্ট : উচ্চ মাধ্যমিকের ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইয়ের ৮৮ নম্বর পৃষ্ঠায় বড় করে দেওয়া একটা ছবি, যেখানে সবার সামনে গোল উদযাপনে ব্যস্ত জাতীয় দলের মিডফিল্ডার মারিয়া মান্ডা। ‘দ্য আনবিটেন গার্লস’ (অপরাজেয় মেয়েরা) এই শিরোনামের গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে মারিয়া, সানজিদারা কীভাবে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে দেশের ফুটবল রাঙাচ্ছে।
গত শনিবার (৪ মার্চ) রাতে পাঠ্যবইয়ে বিষয়টি লিপিবদ্ধ হওয়ার খবরটি ছড়িয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসে কলসিন্দুরের অদম্য মেয়েরা।
পাঠ্য বইয়ে জেলার ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুরের ফুটবল কন্যাদের নিয়ে একটি বিশেষ পাঠ রাখায় উচ্ছ্বসিত ময়মনসিংহবাসী।
ফুটবলকন্যা সানজিদা আক্তার বিষয়টি জানার পর তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে লিখেছে, কলসিন্দুর এলাকার মেয়ে হিসেবে আমি গর্ব অনুভব করছি।
বিষয়টি জানার পর কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং নারী ফুটবল দলের টিম ম্যানেজার মালা রানী সরকার তার ফেসবুক পেজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লেখেন, উচ্চ মাধ্যমিক ইংরেজি বোর্ড বইয়ে কলসিন্দুর নারী ফুটবল নিয়ে একটি বিশেষ লেসন (পাঠ) রাখায় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ধন্যবাদ জানাই নারী ফুটবলার ও যাদের অনুপ্রেরণায় আজ কলসিন্দুর নারী ফুটবল এতদূর এগিয়েছে তাদের, জয় বাংলা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অপ্রতিরোধ্য এই ফুটবল কন্যাদের শুরুটা ২০১১ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে। জেলার সীমান্তবর্তী এলাকার গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কলসিন্দুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে উঠে আসে একদল কিশোরী ফুটবলার। যাদের পায়ের যাদুতে ধুঁকতে থাকা নারী ফুটবল ফিরে পায় আলো। আসে একের পর এক সাফল্য। তাদের বদৌলতে সরকারিকরণ হয় কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবর্ধনাও পায় মেয়েরা।
এবার সানজিদা, মারিয়া, তহুরা, শামসুন্নাহার, শিউলি আজিম, নাজমা আক্তার, মার্জিয়া আক্তারদের জিবনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। লেখা হয়েছে অকালে মৃত্যুবরণ করা সাবিনা খাতুনকে নিয়েও। বাদ যায়নি শিক্ষক-কোচও।
বড়দের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হচ্ছে ছোটরাও। সানজিদা, মারিয়া, তহুরা, শামসুন্নাহার এবং মার্জিয়াদের মতো তারাও নিজ দক্ষতায় এগিয়ে যেতে চায়। সাফল্য ধরে রাখতে কিশোরীদের পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানিয়েছে প্রশাসন।
এ বিষয়ে কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার বলে, আমরা কেবল একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েই আপুদের গল্প পেলাম ইংরেজি বইয়ে। এর চেয়ে আর আনন্দের কী হতে পারে। আমরাও তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে চাই।
এ বিষয়ে তহুরা আক্তারের বাবা ফিরোজ মিয়া বলেন, আমাদের মেয়েদের নাম বইয়ে দেখে আমরা খুব খুশি এবং এই মেয়েদের কারণেই আজ কলসিন্দুর দেশবাসীর কাছে পরিচিতি পাচ্ছে। মেয়েদের নাম পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
মার্জিয়া ও তানিয়ার বড় ভাই রাশিদুল ইসলাম বলেন, এলাকাবাসী মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে প্রথমে কটূ কথা বললেও এখন তারাই মেয়েদের সাফল্যে আনন্দিত।
মারিয়া মান্ডার মা এনতা মান্ডা বলেন, মেয়েরা যে আজ অবহেলিত না আজ তাই প্রমাণ হয়েছে। আমি চাই মেয়ে যেন এই দেশকে আরও অনেক সাফল্য এতে দিতে পারে।
ফুটবলার তহুরা খাতুন জাগো নিউজকে বলে, আমি এ বছর একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। আমার গল্প আমি নিজেই বইয়ে পড়বো। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। আমাদের বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে তুলে ধরায় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীসহ সবাইকে অভিনন্দন জানাই।
কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আব্দুল হামিদ বলেন, বইটিতে এত সুন্দর করে কিশোরী ফুটবলারদের খুঁটিনাটি তুলে ধরা হয়েছে, সত্যিই আমরা অভিভূত। একটার পর একটা সাফল্য পাচ্ছি আমরা। মেয়েদের সাফল্যের বিষয়গুলো আমাদেরও অনুপ্রাণিত করে।
কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং নারী ফুটবল টিমের টিম ম্যানেজার মালা রানী সরকার জাগো নিউজকে বলেন, পাঠ্যপুস্তকে আমাদের মেয়েদের এত বড় সাফল্য আসবে কোনোদিন ভাবতে পারিনি। গত দেড় বছর ধরে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করছিলেন অধ্যাপক গৌতম রায়। বিভিন্ন তথ্যের জন্য তিনি প্রায়ই আমাকে কল দিতেন। সরকারের কাছে আর আমাদের তেমন কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। প্রত্যাশার চেয়ে আমরা অনেক বেশি পেয়েছি। সরকারপ্রধান সবসময় সুস্থ থাকুক এই কামনা করি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, মেয়েরা অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। যার বদৌলতে পাঠ্যপুস্তকে তাদের নিয়ে লেখা হয়েছে। মেয়েদের জন্য পাঁচ লাখ টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। যে কোনো প্রয়োজনে যেন তারা টাকাটা খরচ করতে পারে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার শফিকুর রেজা বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, কলসিন্দুরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সবসময় আমরা পাশে থাকবো। পাঠ্যপুস্তকে নাম আসা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। ওদের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। আশা করছি, খেলোয়াড়রা আরও বেশি মনযোগী হবে খেলাধুলায়।#
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত