কিশোরী কেন দ্রুত প্রেমে পড়ে, অল্প কয়েক দিনের পরিচয়ে কেন? কী বলে মনোবিজ্ঞান

গুটিকয়েক কিশোরী কেন দ্রুত প্রেমে পড়ে এবং অল্প কয়েক দিনের পরিচয়ে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যেতে দ্বিধা করে না। এমন প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘প্রেমিকের’ হাত ধরে পালিয়ে যায় ১১ বছরের কিশোরী আরাবি ইসলাম সুবা। ওই ছেলের মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দুদিন পর মেয়েটির খোঁজ মেলে নওগাঁ জেলায়।
বরিশালের একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে সুবা। সম্প্রতি, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তার মায়ের কেমোথেরাপি শুরু হয়। সেজন্য কিছুদিন আগে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের কাছে এক আত্মীয়র বাসায় ওঠেন সুবার পরিবার। রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টার দিকে কৃষি মার্কেট এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় সুবা। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় কিশোরীটির নিখোঁজের সংবাদ।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এই ধরনের ঘটনা মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেকে এই প্রবণতাকে বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক ও আবেগগত উচ্ছ্বাসকে দায়ী করেন।
যেসব কিশোরী দ্রুত প্রেমে পড়ে এবং পালিয়ে যেতে পারে তাদের আত্মসম্মানবোধে কমতি ও আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
যেসব কিশোরী নিজের পরিবার, আপনজন, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ থেকে পর্যাপ্ত ভালোবাসা ও স্বীকৃতি পায় না, তারা বাইরের কাউকে (যেমন প্রেমিক) জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে অতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ‘কারোও মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য হওয়ার’ আকাঙ্ক্ষা অতি প্রবল থাকে।
পারিবারিক সমস্যা ও অভিভাবকদের শাসন-পীড়ন, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বেড়ে উঠা মেয়েরা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বাবা-মায়ের সম্পর্কে বৈরিতা, পরিবারে দুর্ব্যবহার, অবহেলা বা কঠোর বিধিনিষেধ থাকে, সেক্ষেত্রে কল্পনাজগতে প্রেমিক তার কাছে মুক্তির উপায় হয়ে ওঠে।
অল্প বয়সে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা না শিখলে কিশোর বয়সে আবেগ প্রবণতা আরও তীব্রতর হতে থাকে। কিশোর বয়সে মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ বা ফ্রন্টাল কর্টেক্স যা সিদ্ধান্ত নেয়া জন্য দায়ী তা পুরোপুরি পরিপক্ব হয় না। ফলে, তারা ভবিষ্যতের পরিণাম না ভেবে তাৎক্ষণিক আবেগে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
রোমান্টিক সিনেমা ও সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব তাদের মনোজগতে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়।
সিনেমা, সিরিয়াল, উপন্যাস বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাবিত কিশোরীর আবেগী মনের গভীরে ‘প্রেম মানেই সব’ এমন ধারণা তৈরি হয়।
তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করে, প্রেম মানেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং প্রেমের জন্য যে কোনো কিছু ত্যাগ করা বীরত্বের প্রতীক। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল, অভিজ্ঞতার অভাবে এবং বাস্তব জ্ঞান না থাকার ফলে তারা অল্প পরিচয়ে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
প্রেমিক যদি তাদের স্বপ্নের মতো করে কথা বলে বা বিশেষভাবে যত্ন নেয়, তাহলে তারা তাকে বাস্তবের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করতে পারে।
এটি কি মানসিক সমস্যা?এটি সরাসরি মানসিক রোগ নয়, তবে কিছু মানসিক অবস্থা বা সংকটের কারণে এই প্রবণতা তীব্রতর হতে পারে।
আনুগত্যজনিত মানসিকতা (ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার- ডিপিডি) এমন একটি অবস্থা যেখানে কেউ কারও ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
আবেগ নিয়ন্ত্রণের অভাবজনিত (ইমোশনাল ডিসরেগুলেশন) কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বিচ্ছিন্নতাজনিত সমস্যা যেমন শৈশবে মা-বাবার সঙ্গে সুস্থ মানসিক সংযোগ গড়ে না ওঠে, সেক্ষেত্রে কিশোরীরা প্রেমিকের মাধ্যমে সেই অভাব দূর করার চেষ্টা করতে পারে।
মনোবিজ্ঞান কী বলে? একটি সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ ও খোলা মনোভাবসম্পন্ন আলোচনার সুযোগ থাকলে কিশোরীরা দায়িত্বপূর্ণভাবে এবং ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে শেখে।
কিশোরীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ না করে বরং তাদের ওপর সতর্ক নজরধারী এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কিশোরী বয়সে মেয়ের মনে আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। পরিবারের সদস্যরা, শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠ্যদের উচিত কিশোরীদের শেখানো যে তাদের সম্মান কেবলমাত্র প্রেমে সফলতার মধ্যে নয়, বরং তাদের নিজস্ব ক্ষমতা, দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যেও রয়েছে।
যদি কোনো কিশোরীর মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা বা আত্মবিশ্বাসের অভাব স্পষ্ট হয়ে দেখা যায়, তাহলে প্রয়োজন হলে তাকে কাউন্সেলিংয়ে নেয়া যেতে পারে।
সুতরাং, কিশোরীদের প্রেম ও সম্পর্ক নিয়ে এমন আচরণ শুধুমাত্র মানসিক সমস্যা নয়, বরং এটি পরিবার, সমাজ, আবেগ ও ব্যক্তিত্ব গঠনের সঙ্গে জড়িত। সচেতনতা ও সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তারা আরও পরিপক্ক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত