ইস্তাম্বুল খাল: সুলতান সুলায়মানের স্বপ্নের প্রকল্প শুরু করলেন এরদোগান
তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান শনিবার উদ্বোধন করেছেন ইস্তাম্বুল খাল বা ক্যানাল ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের। এটি এমন একটি খাল যা, সারা বিশ্বে প্রচুর আলোচিত- সমালোচিত। ৩০০ মিটার প্রস্থ, ২১ মিটার গভীর আর ৪৫ কিলোমিটার লম্বা এই খাল নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। গত কয়েক বছর ধরে তুরস্কের ভিতরে এবং বাইরে এই খালের পক্ষে এবং বিপক্ষে চোলছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা।
এরদোগান বলছেন, এই খাল তার স্বপ্নের প্রকল্প। বিরোধীরা বলছে এটা ইস্তাম্বুলের জন্য বিপর্যয়। এরদোয়ান বলছেন এই খাল তুরস্কের অর্থনীতিতে গতি নিয়ে আসবে। বিরোধীরা বলছে তুরস্কের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে আরও হুমকির মুখে ফেলে দেবে। এরকম নানা প্রশ্নে জর্জরিত এই প্রকল্প।
তবে সবকিছু উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত শুরু হলো এই প্রকল্পের কাজ। খাল খননের আগেই এই খালের উপর ব্রিজগুলো তৈরি করা হবে যাতে পরবর্তীতে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত না ঘটে। আর তারই অংশ হিসেবে গতকাল এরদোগান উদ্বোধন করলেন একটি ব্রিজের কাজ।
কেন এই খাল?
তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুল। দেশটির অর্থনীতির তিনের একভাগ আসে এই শহর থেকে। ইস্তাম্বুলকে বলা হয় তুরস্কের অর্থনীতির প্রাণ। আর ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই শহরটিকে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন দুনিয়ার রাজধানী। সেই ইস্তাম্বুলের বুক চিরে কৃত্রিম একটি জলপথ করতে চান এরদোগান। নাম ইস্তাম্বুল খাল। এটা হবে সুয়েজ খাল এবং পানামা খালের মত মানব তৈরি খাল। এটা এরদোগানের ‘ক্রেজি প্রজেক্ট’ হিসেবে পরিচিত।
৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রস্তাবিত এই খালটি কৃষ্ণ সাগরকে মারমারা সাগরের সঙ্গে যুক্ত কোরবে। এটা হবে ইস্তাম্বুলের মধ্য দিয়ে কার্গো জাহাজ চলাচলের দ্বিতীয় পানিপথ। কারণ, ইস্তাম্বুলের মধ্য দিয়ে অলরেডি একটা নৌপথ আছে। যা ব্যবহার হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে। সেটা হলো বসফরাস প্রণালি। সাত হাজার বছর আগে উপত্যকার জমি ধ্বসের ফলে তৈরি হয় এই জলধারা। কৃষ্ণসাগরের তীর ঘেঁষা দেশগুলোর সমুদ্রপথে বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্তে যেতে এই বসফরাস প্রণালি ব্যবহার ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তুরস্ক ছাড়াও, রাশিয়া, ইউক্রেন, জর্জিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ জলপথ এই প্রণালি। প্রতিবছর চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার জাহাজ চলাচল করে এই প্রণালী দিয়ে।অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১০ টি থেকে ১৩০ কার্গো শিপ পার হয় এখান থেকে।
এই প্রণালীটিই বিভক্ত করেছে এশিয়া এবং ইউরোপকে। অর্থাৎ এর এক পাশ এশিয়া আরেক পাশ ইউরোপ।এর কেনার ধরে গড়ে উঠেছে নান্দনিক সব, প্রাসাদ, ম্যানশন, সরাইখানা, সরকারি ভবন। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের রুটি রোজগারের মাধ্যম এই বসফরাস প্রণালি। এছাড়াও হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই বসফরাস হয়ে উঠে ইস্তাম্বুলের জীবন্ত হৃদয়।
সেই বসফরাসের প্যারালালে তৈরি হবে নতুন এই খালটি। বসফরাস থেকে মাত্র ১৫ – ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইস্তাম্বুলে অলরেডি একটা নৌপথ থাকতে একই কাজে আরকটি খাল কেন খনন করতে হবে? সরকার বলছে এই নতুন খাল বসফরাসের উপর কার্গো শিপের চাপ কমাবে। খাল খনন হলে সাধারণ মানুষের জন্য আরও নিরাপদ হবে বসফরাস। কারণ বসফরাস দিয়ে নিরপদ কার্গো পরিবহনের সংখ্যা বছরে ২৫ হাজার কিন্তু এখন পার হচ্ছে বছরে ৪৩ হাজার। অর্থাৎ প্রায় দিগুণ। তাই এই নান্দনিক এবং ঐতিহাসিক প্রণালিটি এখন ঝুঁকির মুখে।
এই খাল খনন হলে যেসব সুবিধা হবে
এছাড়াও এখন বসফরাস দিয়ে অতিবাহিত কার্গো জাহাজ থেকে তুরস্ক কোনো টোল আদায় করতে পারছে না। নতুন এই খাল থেকে বিপুল পরিমাণে টোল আদায় করতে পারবে।
অন্যদিকে নতুন এই খালকে ঘিরে গড়ে উঠবে বিশাল আবাসিক এলাকা। প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ লোকের জন্য আবাসস্থল তৈরি হবে সেখানে। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, কল কারখানা, সহ মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য নতুন নতুন অনেক প্রকল্প চালু হবে সেখানে। ইস্তাম্বুলের জনসংখ্যা ঘনত্বকে অনেক কমিয়ে আনবে নতুন এই শহরায়ন প্রকল্প। প্রায় ২০ হাজার মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
এছাড়াও এর মাধ্যমে আসবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ। এগুলো সবই সরকারের যুক্তি।
খাল খননের বিরোধীদের যত যুক্তি
যারা এর বিরোধিতা করছে তারা বলছে, বসফরাস থাকতে আরেকটি প্রণালির দরকার নাই। বসফরাস দিয়ে মালবাহী জাহাজ ফ্রি পার হতে পারলে নতুন খাল দিয়ে কেন টাকা দিয়ে পার হবে? এই খাল খননের জন্য যে ৯-১০ বিলিয়ন ডলার লাগবে সরকার তা কোথায় পাবে? দেশ থেকে পাবে না কারণ অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। আর বিদেশ থেকেও আনা উচিত না, কারণ তাতে বৈদেশিক ঋণ বাড়বে।
বিরোধীরা কারণ হিসেবে বলছেন, আরও এই খাল খনন করার সময় পরিবশ দূষণ হবে, বিপর্যয় নেমে আসবে ইস্তাম্বুলে। প্রস্তাবিত খালের জায়গায় হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাবে। ইস্তাম্বুলের খাবার পানির সমস্যা হবে। পানির নিচের ইকোলজি নষ্ট হয়ে যাবে। ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়বে। এরকম ভুরি ভুরি যুক্তি আছে তাদের।
আজকে এই দুই পক্ষের বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করবো না। পরবর্তী লেখায় এই বিতর্ক খণ্ডন করবো।
এই খাল খনন প্রকল্প কখন শুরু হয়?
২০১১ সাল! এরদোগানের ক্ষমতায় আরোহণের অষ্টম বছর। একের পর এক নির্বাচনে জিতে চলছেন এই তুখুড় রাজনীতিবিদ। চাঙ্গা দেশের অর্থনীতি। সুখী দেশের মানুষ। দেশে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাকে টেক্কা দেওয়ার মত কেউ নেই। এক কথায় বলতে গেলে এরদোগানের নেতৃত্বে তখন তুরস্ক পার করছিল তার স্বর্ণযুগ। অন্যসব দেশের সঙ্গেও তখন তুরস্কের সম্পর্ক খুবই ভালো। সে বছর সংসদ নির্বাচনের প্রচারনা চলছে।
নির্বাচনী ইশতিহারে এরদোগান সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। ঘোষণা দিলেন তিনি নিয়ে আসছেন এক ক্রেজি প্রজেক্ট। ইস্তাম্বুলে নতুন একটি খাল খননের ঘোষণা দিলেন তিনি। সারা দেশে হই হই রই রই আওয়াজ পরে গেল। সর্বদা আলোচিত ছিল এই প্রজেক্ট। ইস্তাম্বুল আসলে তুরস্কের অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু তাই এই প্রজেক্ট ইস্তাম্বুলে হলেও আকর্ষণ করেছিল সারা দেশের মানুষের মন। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতলেন এরদোগান। কিন্তু এই খাল আর খনন করা হোলো না। কারণ তারপর থেকেই তিনি মুখো মুখী হয়েছেন একটার পর একটা সমস্যার। কখনো দেশের ভিতরে কখনো বাইরে। দশ বছর পরে এসে এখন আবার জোড়েশোরে আলোচনা হচ্ছে সেই খালের। কিন্তু এবার ইস্তাম্বুলের ক্ষমতায় নেই এরদোগানের দল। ইস্তাম্বুলের মেয়র বিরোধী দলের। তিনিই লিড দিচ্ছেন এই খাল বিরোধী ক্যাম্পেইনের। কিছুতেই করতে দিবেন না এই খাল খনন। ইস্তাম্বুলে রাস্তায় রাস্তায় বিলবোর্ড টাঙিয়েছেন এই খালের বিরুদ্ধে। ব্যাপক ভাবে প্রচার চালাচ্ছেন। তাকে সমর্থন দিচ্ছে এরদোগান বিরোধী সব রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়া, এবং বিদেশী অনেক রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা।
সুলতান সুলেমানের স্বপ্নের প্রকল্প
আসলে এই খাল খননটি একটি স্বপ্নের প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সুলতান সুলায়মান। যাকে আপনারা টিভি সিরিজের মাধ্যমে চিনেন। সেই বিখ্যাত অটোমান সুলতান প্রথম প্রস্তাব করেন একটি খাল খননের যা মারমারা সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরকে যুক্ত করবে। কিন্তু সেই খালের রুট ছিল আজকের রুট থেকে পুরাই ভিন্ন একটি জায়গায়। এখন ইস্তাম্বুলের ইউরোপিয়ান সাইডে খাল খননের প্লান করা হচ্ছে আর তখনকার প্লানে ছিল ইস্তাম্বুলের এশিয়ান সাইডে। উদ্দেশ্যও ছিল ভিন্ন। কিন্তু ফলাফল একই। মারমারা এবং কৃষ্ণ সাগরকে খাল কেটে যুক্ত করা। পরে অবশ্য সে প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।
সুলতানের পরেও অনেকবার আলোচনায় আসে এই খাল খনন।১৯৯০ সালে খুব জোড়েশোরেই আবার আলোচনায় আসে এটি। তখনকার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একজন কনসালট্যান্ট এ নিয়ে বিশাল বিশাল আর্টিকেল লেখেন। “আমি ইস্তাম্বুল খালের কথা ভাবছি,” শিরোনামের একটি আর্টিকেলটি তখন অনেক জায়গায় ছাপানো হয়। এমনকি তুরস্কের টুবিটাকের অনেক প্রেস্টিজ সম্পন্ন সাইন্স ম্যাগাজিনেও ছাপানো হয় সেটা ।১৯৯৪ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং গণতান্ত্রিক বাম দলের নেতা বুলেন্ত এজেভিত ইস্তাম্বুইলর ইউরোপিয়ান সাইডে একটি খাল খননের প্রস্তাব করেন। তার নির্বাচনী ইশতিহারে ছিল এটি।
এসব আলোচনায় আমরা বুঝতে পারি যে, এই খাল খনন প্রকল্পটি ষোড়শ শতাব্দী থেকেই তুর্কীদের মাথায় ছিল। কখনো আলোচনা হয়েছে। কখনো নির্বাচনে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, আবার কখনওবা বিস্তারিত ছকও আঁকা হয়েছে। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি। আর কখনো বর্তমানের মত এত সমালোচনার মুখেও পড়েনি তুর্কিদের এই স্বপ্নের প্রজেক্ট।
তবুও সবকিছুকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি এরদোগান শেষ পর্যন্ত শুরু করেলেন এই খাল খনন।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত