নিজের সন্তান যদি আপনাকে মারে, তখন কী করবেন?
নিজের মারমুখি সন্তানের হাতে মার খেতে হবে- বেশিরভাগ বাবা-মাকে কখনোই এরকম ভয়ে থাকতে হয় না। কিন্তু যখন এরকমটা ঘটে, তখন বাবা-মাকে আসলেই খুব কঠিন এক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়তে হয়। সন্তান এমন আচরণ করলে তাকে ছেড়ে চলে যাবেন, সেটা যেমন পারেন না, তেমনি যদি এই সমস্যার জন্য সাহায্য চান, সেটি সন্তানের ওপর কী প্রভাব ফেলবে সেটাও নিয়েও বাবা-মা শংকায় থাকেন। গবেষণায় দেখা যায়, এধরণের সমস্যাগুলো সচরাচর লুকিয়ে রাখা হয়, এবং এরকম সমস্যা আমরা যা ধারণা করি তার চেয়ে অনেক বেশি।
গত গ্রীষ্মে দশ বছর বয়সী এইডান সিদ্ধান্ত নিল তাদের পরিবারের পোষা কুকুরটাকে মেরে ফেলবে। একটা সসেজের লোভ দেখিয়ে কুকুরটাকে সে সোফার পেছনে নিয়ে গেল, তারপর দুই হাতে কুকুরটির নাকমুখ আর গলা চেপে ধরলো।
`কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ও কিন্তু আর সবার চেয়ে কুকুরটাকে এবং আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে’, বলছিলেন এইডানের মা হ্যাজেল। `কিন্তু আমাদের দুজনকেই ও বেশি আঘাত করবে, এবং অনেক সময় ও কুকুরটাকে আঘাত করবে শুধু আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য।’
এইডান রেগে গেলে লাথি মারে, ঘুষি মারে। আগে কামড়ে দিত। সে তার মা হ্যাজেলকে বলে, তাকে সে ঘৃণা করে এবং সে চায় তার মা যেন মরে যায়। সে একটা বন্দুক নিয়ে এসে তার মাকে গুলি করে মেরে ফেলবে। এইডান তার মাকে সিঁড়ি থেকে ঠেলে নীচে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এখন এইডান জানে, তার মায়ের দুর্বলতা আসলে কোথায়।
হ্যাজেলের চোখে সমস্যা আছে। কাজেই এইডান তার দিকে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারে, যেগুলো হ্যাজেল দেখতে পায় না। সম্প্রতি এইডান তার মায়ের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল একটি কেটলি। সৌভাগ্যবশত তখন এটিতে ফুটন্ত পানি ছিল না। তবে এইডান জানতো না যে কেটলিটি ঠান্ডা, সে কেটলি তুলে ছুঁড়ে মেরেছিল।
`এগুলো দেখে খুবই নিপীড়নমূলক আচরণ, একধরণের গুন্ডামি বলে মনে হবে। আমার মনে হয় আমি যেন একধরণের পারিবারিক সহিংসতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে আছি। আপনার স্বামী আপনাকে প্রথমবার আঘাত করার পরই কিন্তু আপনি বলতে পারেন, এই সম্পর্কে আপনি আর থাকবেন না, সংসার থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু আপনার সন্তানের সঙ্গে তো আপনি সেই কাজটা করতে পারেন না, তাই না? কারণ এই শিশুকে রক্ষার দায়িত্ব আপনার কাঁধেই, কিন্তু একই সঙ্গে আপনি তার সহিংসতারও শিকার”, বলছেন হ্যাজেল।
একবার এইডান রান্নাঘরে ড্রয়ার থেকে ছুরি নিয়ে পরিবারের আরেক সদস্যের দিকে তেড়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে বাড়ির সব ছুরি এইডানের হাতের নাগালের বাইরে তালা মেরে রাখা হয়। কিন্তু এইডান যা পায় সেটাই ব্যবহার করে, সেটা কাঁচি বা নখ কাটার ক্লিপার্স, যেটাই হোক।
`ওর যে কোনো আচরণই সহিংসতার দিকে গড়ায়। ও সহিংস পথটাই বেছে নেবে, যে কোন পরিস্থিতিতে ও কেবল সহিংসতাই দেখে। আমরা এমনকি বাচ্চাদের অনুষ্ঠান পর্যন্ত দেখতে পারি না, সেখানে যদি সামান্য সহিংসতার কোন দৃশ্য থাকে, ও সেই কাজটাই বাস্তবে করে দেখাবে, বার বার করবে’ বলছেন হ্যাজেল।
হ্যাজেল এবং তার স্বামী যখন এইডানকে দত্তক নেন, তখন ওর বয়স চার। শুরুতেই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে এইডানের যে ধরণের সেবা-যত্নের দরকার বলে তারা ভেবেছিলেন, ওর অবস্থা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।
‘প্রথম দিন থেকেই আমরা জানতাম ওর গুরুতর কিছু সমস্যা আছে’, বলছেন হ্যাজেল। ‘কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম ও একটা অদ্ভুত পরিবেশে ছিল, ওকে যে ধরণের পরিবেশে এর আগে দত্তক দেয়া হয়েছিল, সেখানকার পরিবেশ হয়তো ভালো ছিল না…দেখা যাক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়।’
কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ভালো দিকে যায়নি। একেবারে শুরু থেকেই এইডান ঘুষি মারতো, চুল ধরে টানতো, থুতু ছিটাতো। হ্যাজেল এবং তার স্বামী আশা করেছিলেন ওর এই সহিংস আচরণ ধীরে ধীরে বন্ধ হবে, কিন্তু অবস্থা আসলে খারাপ হচ্ছিল। একটি স্কুলের যে বিশেষ শাখায় এইডানকে ভর্তি করা হয়েছিল, সেখানে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই এইডানের মার খেয়ে দুজন সহকারীকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। এদের একজনের মুখে জোরে লাথি মেরেছিল এইডান। ও রেগে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলেছিল মেঝেতে। উবু হয়ে মাটি থেকে জিনিসটি যখন তুলতে যাচ্ছিলেন স্কুলের এই সহকারী, তখন এইডান একেবারে সোজা তার মুখে জোরে লাথি মারে।
এইডান যখন রেগে-মেগে এরকম সহিংস আচরণ করতে থাকে, তখন কীভাবে ওকে সামলাতে হবে, তার জন্য স্কুলের স্টাফদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। হ্যাজেলের মনে আছে প্রথম যেদিন এইডানকে প্রায় বাড়তি ৫০ মিনিট ধরে আটকে রাখা হয়েছিল।
‘এইডান ওর ক্লাশরুমে একটা ছোট্ট সোফায় বসে ছিল। ওর কাপড় খুলে ফেলা হয়েছিল, কেবল গেঞ্জি পরা, কারণ ও ঘামছিল। পাশে দাঁড়িয়ে একজন সহকারী। এইডান কাঁপছিল, থরথর করে কাঁপছিল। কী যে ভয়ানক এক দৃশ্য। আমি ওর পাশে বসলাম, তখন ও আমার হাঁটুর ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসলো, যেভাবে জঠরের ভেতর সন্তান থাকে, সেরকম। কী মর্মান্তিক এক দৃশ্য।’
এখন যখন পেছন ফিরে তাকান, তখন হ্যাজেল ভাবেন, স্কুলের স্টাফদেরকে এভাবে এইডানকে সামলানোর অনুমতি দেয়াটা ঠিক ছিল কীনা। তবে এছাড়া ওরা আর কীভাবে এইডানকে সামলাতো, সেটাও তিনি বুঝতে পারেন না।
‘এই ঘটনায় ওর ওপর নিশ্চয়ই সাংঘাতিক বাজে প্রভাব পড়েছে, কিন্তু আমি জানি ও কতটা সহিংস ছিল’, বলছেন হ্যাজেল। ‘স্কুলের শিক্ষকদের সারা গায়ে ছিল আঁচড়ের দাগ, আমি জানিনা, এইডানকে নিরাপদ রাখার জন্য ওরা আর কী করতে পারতো।’
এই ঘটনার পর স্কুলে একটি বিশেষ রুম তৈরি করা হয় নরম প্যাড দিয়ে। এইডান যখন নিজেই নিজের জন্য বা অন্যদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠছে, তখন ওকে এই রুমে রাখা হতো।
‘কিন্তু ওকে আসলে প্রতিদিনই এই রুমে পাঠাতে হচ্ছিল। ও এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল যে, দরোজার শক্ত কাঁচ ও তিনবার ভেঙ্গে ফেলেছিল।’
এরকম এক পরিস্থিতিতে একদিন স্কুল কর্তৃপক্ষ হ্যাজেলকে জানালো, তারা আর এইডানের দেখাশোনা করতে পারবে না।
২০১০ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা প্রথমবারের মতো সন্তানের হাতে বাবা-মার সহিসংতার শিকার হওয়ার বিষয়ে একটি গবেষণা চালান। তারা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া এ সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করেছিলেন। সেবছরের বারো মাসের মধ্যে কেবল লণ্ডনেই এধরণের ১ হাজার ৯০০ ঘটনা পুলিশের খাতায় রেকর্ড করা হয়েছিল।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ক্রিমিনোলজির অধ্যাপক র্যাচেল কনড্রি। তার অনুমান, প্রতি বছর গোটা দেশজুড়ে হয়তো এরকম ঘটনা ঘটছে হাজার হাজার, যার বেশিরভাগই আসলে পুলিশের কাছে আসছে না।
‘এই সমস্যাটাকে আসলে আড়াল করা হচ্ছে- কত বাবা-মা যে আছে, যারা মনে করে এটা তারা পুলিশকে জানাতে পারবে না। বা হয়তো এরা কারও কাছে এই সমস্যার জন্য সাহায্যও চায় না, কিংবা তারা হয়তো সেরকম সেবা খুঁজেও পায় না’, বলছেন তিনি।
অনেক বাবা-মা র্যাচেল কনড্রিকে জানিয়েছেন, তারা অনেক বছর ধরে সন্তানের সহিংসতার শিকার হওয়ার পরই কেবল পুলিশের কাছে সন্তানের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন। তারা যখন কেবল নিজেদের জীবন নিয়ে আশংকায় ছিলেন, তখনই কেবল পুলিশের কাছে গেছেন।
‘নিজের সন্তানকে তারা আসলে অপরাধী বলে চিহ্নিত করতে চান না, এর কী পরিণাম হবে সেটা নিয়ে আসলে তারা চিন্তিত,’ বলছেন তিনি।
র্যাচেল কন্ড্রির গবেষণার আগে এই বিষয়ে খুব কম গবেষণাই হয়েছে। এরকম একটা সমস্যা যে আছে, সেটা নিয়েই আসলে কোন সচেতনতা ছিল না।
‘কোন সরকারি ওয়েবসাইটে এর কোন উল্লেখ ছিল না, কোন সরকারি নীতিতেও না-কোথাও এর কোন উল্লেখ নেই’, বলছেন তিনি। ‘কিন্তু আমি যখন এরকম শিশু এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম, নানা ধরণের জায়গায়, তখন ওরা জানালো, এমন কেস তাদের কাছে সব সময়ই আসে। কাজেই এটা নিয়ে আসলে একটা অদ্ভুত নীরবতা ছিল।’
এরকম সমস্যার শিকার পরিবারগুলো হয়তো তাদের বন্ধুদেরও বিষয়টা বলতো না।
সাবেক সোশ্যাল ওয়ার্কার হেলেন বনিক সন্তানের হাতে পিতা-মাতার সহিংসতার শিকার হওয়ার বিষয়ে একটি বই লিখেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে পরিবারগুলো এক ধরণের মারাত্মক লজ্জায় ভুগতো।’
‘বাবা-মা হিসেবে আপনার দায়িত্ব আপনার শিশুকে সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তাকে একজন মানবিক, দয়ালু, পরোপকারী মানুষ হিসেবে বড় করা। যদি এটা করতে না পারেন, তখন লোকে ভাববে এটা বাবা-মার ব্যর্থতা। কাজেই এরকম সমস্যা নিয়ে আসলে বাবা-মা কথা বলতে চান না। আর যেহেতু এটা নিয়ে কেউ কথা বলে না, তখন আপনার হয়তো মনে হতে পারে এরকম সমস্যাতে বুঝি শুধু আমি একাই আছি।’
পারিবারিক সহিংসতা বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে সহিংসতার শিকার হওয়ার মতোই সন্তানের হাতে বাবা-মার সহিংসতার ঘটনা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরেই ঘটে। যেসব শিশু সমাজসেবা দফতরের তত্ত্বাবধানে বড় হচ্ছে, এটা কেবল তাদের ক্ষেত্রেই ঘটে বলে ধরে নিলে ভুল করা হবে।
একটি দাতব্য সংস্থা ‘প্যারেন্টাল এডুকেশন গ্রোথ সাপোর্টের’ সঙ্গে কাজ করেন মিশেল জন। এই সংস্থাটি এ ধরণের সহিংসতার শিকার পরিবারগুলোকে সাহায্য করে। মিশেল জন বলছেন, তাদের সংস্থা দত্তক পরিবারের চাইতে জন্মদাতা পরিবারকেই আসলে অনেক বেশি সাহায্য করেন।
হ্যাজেলের পরিবারে যেমনটা ঘটেছে, বেশিরভাগ পরিবারেও আসলে মায়েরাই এরকম সহিংসতার টার্গেট হন বেশি।
‘সব ধরণের পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রেই মেয়েরাই শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এবং এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই’, বলছেন র্যাচেল কন্ড্রি। ‘এটা বাবাদের বেলায়ও ঘটে, কিন্তু সন্তানের হাতে সহিংসতার শিকার সচরাচর মায়েরাই বেশি হন।’
এখন স্থানীয় কোন স্কুলই আর এইডানকে ভর্তি করতে চাইছে না। এলাকার সব বিশেষ স্কুলই হয় তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে অথবা বহিস্কার করেছে। সবচেয়ে কাছের যে স্কুলে এখন সে যেতে পারবে, সেটা গাড়িতে প্রায় আধঘন্টার পথ। আর এইডানের সমস্যা যেরকম জটিল, সেই স্কুলে আসলে তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থাও নেই।
‘ওরা আসলে এইডানকে কোন রকমে সামলে রাখছে, ওর সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না’, বলছেন হ্যাজেল। পড়াশোনার দিক থেকে এইডান ওর বয়সী শিশুদের তুলনায় তিন-চার বছর পিছিয়ে আছে। তবে ওর হাতের লেখা খুব সুন্দর।
এরকম সহিংসতার শিকার আরও বহু পরিবার
এইডানের সহিংস আচরণ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তার কিছু কৌশল শেখার জন্য হ্যাজেল একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন নিজের অর্থ খরচ করে। একটা কৌশল হচ্ছে, এইডান যাতে তাকে আঘাত দিতে না পারে, সেজন্য একটি বড় সোফা কুশন ধরে রাখা।
‘প্রথম দিন ও আমার কাছ থেকে কুশনটা কেড়ে নিয়ে সেটা দিয়েই আমাকে আঘাত করলো। তখন আমি ভাবলাম, কুশনটা আমাকে আরো জোরে ধরে রাখতে হবে। দ্বিতীয়বার এই কৌশলটা বেশ কাজ করলো। আমাদের দুজনের মাঝখানে আমি কুশনটা ধরে রাখলাম। এইডান ওটার ওপর দিয়ে ঘুষি মারছিল, লাথি মারছিল, সেটাকে পাশ কাটিয়ে আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করছিল, তবে পারছিল না।’
হ্যাজেল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তার সন্তান খারাপ কোন মানুষ নয়। কিন্তু অতীতে এমন কিছু ঘটেছে, যার কারণে হয়তো এইডানের ওপর এরকম প্রভাব পড়েছে, এটা তার দোষ নয়।
‘যদিও মনে হতে পারে ও একজন উৎপীড়ক, কিন্তু আসলে তা নয়, ও আসলে নিজেকে সামলাতে পারে না। ও আসলে এত মিষ্টি স্বভাবের এক শিশু, এত আদরের, এত মজার। আমরা দুজনে আসলে দুজনকে ভালোবাসি।’
কিন্তু এই সমস্যার ধকলের কারণে হ্যাজেলকে তার চাকুরি ছাড়তে হয়েছে। তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। তার কুঁচকিতে ঘা হয়েছে কয়েকবার, গত বছর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন একাধিকবার। তিনি এখন বিষণ্নতায় ভুগছেন, তাকে ঔষধ খেতে হচ্ছে। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।
‘আমরা যখন প্রথম বুঝতে পারলাম অনেক সমস্যা আছে এবং এগুলো বেশ কঠিন, তখন আসলে আমরা দুজনেই অনুভব করছিলাম আমরা ভুল করেছি এবং আমরা এটা নিতে পারছিলাম না। কিন্তু এই সমস্যার কথা মুখ ফুটে বললে আপনাকে তো কিছু একটা করতে হবে, কাজেই আমরা কেউই আর মুখ ফুটে সমস্যাটার কথা বলিনি। আমরা আসলে ছয় মাস পর্যন্ত একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলিনি।’
সমস্যা আছে বুঝবেন কেমন করে?
একজন শিশুর আচরণ যখন হুমকিজনক, ভীতিকর, এবং অনিরাপদ হয়ে উঠে, তখন এটি আর স্বাভাবিক কোন আচরণ নয়। ‘হু ইজ ইন চার্জ’ কর্মসূচী এমন কিছু লক্ষণের দিকে নজর রাখতে বলেছে:
আপনার সন্তানের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে আপনি নিজের আচরণ বদলাচ্ছেন
নিজের নিরাপত্তা অথবা পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে আপনি ভয়ে আছেন
আপনার সন্তান চুরি করছে বা পরিবারের অন্য সদস্যদের জিনিস নষ্ট করছে
আপনাকে বা পরিবারের অন্য সদস্যকে হুমকি দিচ্ছে
শিশুটি নিজে নিজের ক্ষতি করবে বলে হুমকি দিচ্ছে অথবা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করছে-এরকম হুমকি সবসময় গুরুত্বের সঙ্গে নিন
পোষা প্রাণীর সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করছে
কয়েক বছর আগে অনেক চিন্তাভাবনার পর হ্যাজেল একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন।
‘আমাদের পুরো পরিবারের ওপর এটা কেমন প্রভাব ফেলছে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন আমি ঠিক করলাম যে আমি এইডানকে নিয়ে চলে যাব।’
হ্যাজেলের স্বামী তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে এই কাজ থেকে নিরস্ত করলেন। হ্যাজেল এখন স্বীকার করেন, এটাই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তারপরও পরিবারের অন্য সন্তানদের জন্য তার মধ্যে একধরণের অপরাধবোধ কাজ করে।
‘তাদের শৈশবকে আমরা আসলে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি’, বলছেন হ্যাজেল।
করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর অনেক আগে থেকেই হ্যাজেল এবং তার পরিবার অন্য মানুষের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা এখন আর বড় কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন না, অন্য কারও অনুষ্ঠানেও যান না।
এইডান যখন স্কুলে থাকে, তখনই কেবল হ্যাজেল নিজের বাবা-মাকে দেখতে যান। কারণ হ্যাজেলকে তারা সামলাতে পারেন না। আর হ্যাজেল কখনোই এইডানকে নিয়ে অন্য কোন বন্ধুর বাড়িতে যান না, যেখানে অন্য কোন শিশু আসতে পারে।
হ্যাজেল এবং তার স্বামী আর বাইরে রাত কাটাতে যেতে পারেন না, সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কিছু করতে পারেন না। কারণ এইডানকে কার কাছে রেখে যাবেন? তাকে কেউ সামলাতে পারে না।
‘এটা মারাত্মক এক নিঃসঙ্গতা’, বলছেন হ্যাজেল।
তবে এক অনলাইন কমিউনিটিতে হ্যাজেল কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে তিনি তার মতো অন্য বাবা-মার সঙ্গে অভিজ্ঞতা শেয়া করতে পারেন।
‘আমাদের মতো অবস্থায় যে আরও অনেক মানুষ আছে, এটা জানার পর যেন আমাদের চোখ খুলে গেল। আমাদের মতো এরকম অনেক, অনেক পরিবার আছে।’
হ্যাজেল একটা স্প্রেডশীটে এইডানের ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থার নানা সিদ্ধান্তের হিসেব রাখেন। এইডানকে কিভাবে সাহায্য করা যায়, সেটা নিয়ে সারাক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
‘সন্তানের হাতে বাবা-মার সহিংসতার শিকার হওয়ার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব কারও উপরেই নেই, আবার এটা আসলে সবারই দায়িত্ব। কারণ এমন কোন সেবা বা সংস্থা নেই, যাদের ওপর এর প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তায়। আমার মনে হয় এটা একটা বাস্তব সমস্যা’, বলছেন র্যাচেল কন্ড্রি।
হ্যজেলের পরিবার এখন ভরসা করছে এইডানকে একটা আবাসিক স্কুলে ভর্তি করার ওপর। এইডানের মতো শিশুদের এই স্কুল তিন বছরের মধ্যে পুরোপুরি পুনর্বাসন করে। তিন বছর এই স্কুলে থাকার পর শিশুরা তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে, নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারে, আবার স্বাভাবিক কোন স্কুলে যেতে পারে।
হ্যাজেল বলেন, ‘আমি আসলে চাই এইডান এমন কোন স্কুলে যাক, যারা ওকে সাহায্য করবে, ওকে সুস্থ করে তুলবে।’
কিন্তু এই আবাসিক স্কুলে ভর্তির নিয়মকানুন বেশ কড়া এবং জটিল। যদি এইডানকে এই স্কুলে না নেয়া হয়, তখন কী হবে, তা নিয়ে হ্যাজেল চিন্তিত।
‘এইডান হয়তো ওর সঙ্গীর সঙ্গেও নিপীড়নমূলক আচরণ করবে, পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াবে।’
‘ও হয়তো মারামারি করে জেলে যাবে, সেটাই আমি দেখতে পাই।’
তবে আপাতত হ্যাজেল পরিস্থিতি যাতে আয়ত্ত্বের বাইরে না যায়, সেই চেষ্টাই করছেন। এইডান যখন স্কুলে যায়, তখন হ্যাজেল তার কুকুর নিয়ে হাঁটতে যান, এরপর এইডান ফেরার আগে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করেন। এইডান ঘরে ফিরেই হয়তো সবকিছু তছনছ করে দেবে, ফলের ঝুড়িটা ছুঁড়ে ফেলবে, রেলিং এর ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে পড়বে।
শান্ত কোন রাতে এইডান তার অডিও বই শোনে, একই গল্প বার বার শোনে, শুনতে শুনতে আবার বইটার পাতাও উল্টাতে থাকে। এরপর যখন ঘুমের সময় হয়, নীচের তলার সব দরোজায় তালা লাগিয়ে দেয়া হয়, যাতে রাতে এইডানের ঘুম ভাঙ্গলেও নীচে গিয়ে কুকুরটাকে বিরক্ত করতে না পারে।
এইডানের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এই প্রতিবেদনে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। সূত্র: বিবিসি
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত