১১ জেলায় নদীভাঙন: বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি

| আপডেট :  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:৫২  | প্রকাশিত :  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:৫২

কয়েক দিনের টানা বর্ষণে ও নদীর পানি বৃদ্ধিতে দেশের ১১টি জেলায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এতে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমিসহ নানা সম্পদ বিলীন হচ্ছে নদীগর্ভে।

চলতি বছর দেশের ১২ জেলার ১৭টি পয়েন্টে নদীভাঙন হতে পারে বলে ৪ সেপ্টেম্বর পূর্বাভাস দেয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা সিইজিআইএস মূলত যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার সম্ভাব্য ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে থাকে।

এবার যমুনার ৯টি স্থানে, গঙ্গার দুটি ও পদ্মার ছয়টি স্থানে ভাঙন হতে পারে। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মাদারীপুর জেলায় ভাঙন তীব্র হতে পারে।

এ বছর দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার এক হাজার ৮০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হতে পারে। ফসলি জমির পাশাপাশি ঘরবাড়ি হারাতে পারে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। গত সপ্তাহে প্রতিবেদন দেওয়ার পরপরই চলতি সপ্তাহে দেশের ১১ জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে।

তথ্য মতে, গত দুই দিনে বগুড়া, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পিরোজপুর, জামালপুর, ভোলা, রংপুর, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের বেশ কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। তবে সিইজিআইএস প্রক্ষেপণের চেয়ে বেশি জেলায় ভাঙন হতে পারে। প্রক্ষেপণের বাইরে বেশ কিছু জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে। যেগুলো প্রাথমিক তালিকায় ছিল না। এর মধ্যে ভোলা, পিরোজপুর ও গোপালগঞ্জ জেলা রয়েছে।

এ বিষয়ে সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান বলেন, ভাঙনের সম্ভাব্য শিকার এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিত সরকারকে তথ্য দিচ্ছে সিইজিআইএস। গত ২৬ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে এবারের প্রক্ষেপণ দেওয়া হয়েছে। সেই প্রক্ষেপণে ১৬৫টি বসতবাড়ি ভাঙনের শিকার হতে পারে। এ ছাড়া ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সোয়া দুই কিলোমিটার সড়ক ও তিন কিলোমিটার বাঁধ ভাঙতে পারে। চারটি জেলা তীব্র ভাঙনের মুখে থাকবে বলে আগে থেকেই কার্যক্রম নেওয়া প্রয়োজন।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও পূর্ণিমার প্রভাবে গত তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে উপকূলীয় এলাকায়। এতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে বিশখালী নদীতে। ঝালকাঠির রাজাপুরে বিশখালী নদীর বাদুরতলা লঞ্চঘাট এলাকায় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে আটটি দোকান ও বেশ কিছু ফসলি জমি। পানি বেড়ে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ কাঁচা রাস্তাঘাট, চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারও মানুষ। আগাম শীতকালীন রবিশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি আমন মৌসুমের বীজতলা পানিতে ডুবে আছে। এ ছাড়া সদ্য রোপণ করা আমনের ক্ষেতও পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে আমনের বীজ সংকটের আশঙ্কা করেছেন কৃষকরা।

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় মধুমতী নদীর পানি বাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। উপজেলার দিকনগর খেয়াঘাটের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অস্থায়ী রক্ষা বাঁধের সাড়ে ৭০০ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রায় ৯০০ মিটার অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু হঠাৎ করে মধুমতী নদীতে পানি বাড়ায় বাঁধের প্রায় সাড়ে ৭০০ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রায় ৩০টি ঘর ভাঙনের হুমকির মুখে।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়টি ভাঙনঝুঁকিতে। জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে। ভবনে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রখর রোদে শিশুদের পাশের বাড়ির উঠানে গাছতলায় বসিয়ে পড়ানো হচ্ছে।

রংপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, ‘বিদ্যালয়টি রক্ষায় জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। তবে স্থায়ীভাবে ভবনটি রক্ষায় সিসি ব্লকের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের পদ্মাতীরবর্তী সাত্তার মেম্বারপাড়া, ইদ্রিস মিয়ারপাড়া, নাসির সরদারপাড়া, ১ নম্বর বেপারীপাড়া, মজিদ শেখেরপাড়া, সিদ্দিক কাজীরপাড়া, সাহাদত মেম্বারপাড়া, নতুনপাড়া ও বাহিরচর গ্রাম, উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের চরদেলুন্দি, ভবানীপুর, গোপালপুর, বেথুরী, চরদেবগ্রাম, কাউলজানি ও মধু সরদারপাড়া গ্রাম এলাকায় নদীর তীর ভাঙন চলছে।

অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে সাত ইউনিয়ন এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। এর মধ্যে চালুবাড়ী ইউনিয়নের মানিকদাই চরের দুই-তৃতীয়াংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সেখানে ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে পাউবো। ওই চরের ২০০ পরিবার এর মধ্যে গৃহহারা।

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বহ্মপুত্র নদের তীব্র ভাঙনে বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শত শত বিঘা জমি, বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের ঝালর চর সিয়ালের টেক থেকে শুরু করে কান্দির গ্রাম, নয়াগ্রাম, ভাটিরপাড়ার দক্ষিণ মাথা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব এবং পশ্চিম দুই পাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় শতাধিক বিঘা ফসলি জমি ও অর্ধশত বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়েছে।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে মধুমতীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুল কাফি মোল্লা ওরফে কাফি হাজি বলেন, ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর সকালে আমার বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে ছিল নদীর পার। দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ ভাঙন শুরু হয়। এক এক করে গাছগুলো নদীর ভাঙনে পানির নিচে চলে যাচ্ছে। এটা দেখে মসজিদের মাইকে গ্রামবাসীকে ডাকলে তারা আসতে আসতে আমার দুটি দালানঘর, দুটি ওয়ালশেড টিনের ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেল। গ্রামবাসী ঘরের মালপত্র সরিয়ে নিতে পারলেও রক্ষা করতে পারেনি আমার ঘরবাড়ি ও শ্যালো মেশিন। এই ভাঙনে আমার প্রায় ১৩ বিঘা ধানের জমি নদীতে মিশে গেছে। সব মিলিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে, তা প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। এখন আমি বাড়ি থেকে প্রায় আধাকিলোমিটার দূরে টিনের ছাপরা তুলে বসবাস করছি। পরিবার নিয়ে দুর্বিষহ অবস্থায় আছি। ’

সাম্প্রতিক বন্যায় সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার মরা নদী নাইন্দাও ভয়াল খরস্রোতা হয়ে ওঠে। তার প্রবল ঢেউয়ে বিলীন ২৪টি পরিবারের আবাস।

ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে ভাঙনে হুমকির মুখে কয়েক হাজার মানুষ। অনেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যের জমি ও বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। ভাঙনে বিলীন প্রায় দেড় হাজার হেক্টর ফসলি জমি। নিঃস্ব শত শত পরিবার।

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত