সম্রাটসহ অন্যদের বিরুদ্ধে করা ২০ মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না
ক্যাসিনো–কাণ্ডে সম্রাট ও আরমানের মতো আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ধরা পড়েছিলেন ১৪ জন। তাঁদের বিরুদ্ধে মোট ৫৫টি মামলা করেছিল পুলিশ, র্যাব ও দুদক। এর মধ্যে ৩৫টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাকি ২০টি মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না।
রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, মাদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, মানি লন্ডারিং আইন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৫৫টি মামলা করেন র্যাব, সিআইডি ও দুদকের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে র্যাব-সিআইডি মিলে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা এবং মানি লন্ডারিং আইনে ৩২টি মামলা করে। অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়ে গ্রেপ্তার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক (মনজু) ছাড়া বাকি ১৩ জনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা করে দুদক।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে মামলার তদন্ত শেষ করতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। মামলাগুলোর তদন্তকাজ প্রায় গুটিয়ে এনেছেন তাঁরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, ক্যাসিনো–কাণ্ডে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তাঁর সহযোগী আরমান, যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, প্রভাবশালী ঠিকাদার যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীম, কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ), মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সেলিম প্রধান, দুই সহোদর এনামুল হক ভূঁইয়া (এনু) ও রুপন ভূঁইয়া, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান (মিজান), তারেকুজ্জামান রাজীব ও ময়নুল হক (মনজু)। এঁদের বিরুদ্ধে র্যাব ১৮টি মামলা করে। অপরাধলব্ধ আয় ও দেশের বাইরে অবৈধ অর্থ পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে মানি লন্ডারিং আইনে ১৪টি মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আর অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে ২৩টি মামলা করে দুদক।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং আইনে হওয়া ১৪ মামলার মধ্যে ১০টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। যুবলীগের নেতা সম্রাটের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাসহ চার মামলার অভিযোগপত্র আটকে আছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, সম্রাটের পাচার করা অর্থের বিষয়ে তথ্য চেয়ে গত বছরের ২৫ অক্টোবর সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠির জবাব না পাওয়ায় মামলার অভিযোগপত্র আটকে আছে।
জি কে শামীম,খালেদ মাহমুদ, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট,মমিনুল হক সাইদ,তারেকুজ্জামান রাজীব ও এনামুল হক আরমান
জি কে শামীম,খালেদ মাহমুদ, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট,মমিনুল হক সাইদ,তারেকুজ্জামান রাজীব ও এনামুল হক আরমানফাইল ছবি
জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান বলেন, মানি লন্ডারিং আইনে হওয়া বেশির ভাগ মামলার অভিযোগপত্র ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
সম্রাটের বিষয়ে যা বললেন তদন্তকারীরা
সিআইডি ও দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৮ কোটি টাকা পাচার করেছেন। ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে লব্ধ এসব অর্থ জমিয়েছিলেন তিনি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করা টাকার বড় অংশই সম্রাট সিঙ্গাপুরে জুয়ার আসর ‘মেরিনা বে-স্যান্ডস’ ক্যাসিনোতে খরচ করেছেন। ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে অবৈধ এসব অর্থ জমিয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত সম্রাট শুধু সিঙ্গাপুরেই গেছেন ৩৫ বার। ওই সময়ের মধ্যে সম্রাট মালয়েশিয়ায় তিনবার, দুবাইতে দুবার ও একবার হংকংয়ে গিয়েছিলেন।
সম্রাট সম্পর্কে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, রাজধানীর কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার দখল করে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি সম্রাট। তিনি ‘গডফাদারদের’ পক্ষে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-তদবির করলেও পরে রাজনৈতিক পর্যায়ে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা থেকে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। সামনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর আবার আলোচনায় আসে ক্যাসিনো ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রকই ছিলেন সম্রাট। অভিযানের শুরুতে কয়েক দিন কাকরাইলে নিজের অফিসে থাকলেও পরে গা ঢাকা দেন। শেষ পর্যন্ত ওই বছরের ৬ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গ্রেপ্তারের পর বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। অস্ত্র ও মাদক রাখায় সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা করা হয়। পরে সিআইডি তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। সম্রাটকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে টাকা আয় করার কথা স্বীকার করেন। জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট পুলিশ ও র্যাবকে ক্যাসিনো পরিচালনা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতাসহ অনেকের নাম বলেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাউকেই আইনের আওতায় আনেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যানের পদ থেকে ওমর ফারুক চৌধুরীকে অব্যাহতি দেয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।
সম্রাটের সহযোগী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলাটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আর মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের করা সিআইডির মামলাটি তদন্তাধীন।
দুদকের মামলা
দুদক সূত্র জানায়, ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২৩টি মামলা করেছিল দুদক। এর মধ্যে সম্রাটের বিরুদ্ধে করা মামলাসহ ১০টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। বাকি ১৩ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
র্যাব ও ডিবির তদন্ত
ক্যাসিনো–কাণ্ডের ঘটনায় র্যাব ১৩টি ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ৫টি মামলার তদন্তভার পায়। তদন্ত শেষে ১৩টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আল মঈন।
ডিবি সূত্র বলেছে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হকের বিরুদ্ধে করা চাঁদাবাজির মামলা ও দুই সহোদর এনু-রুপনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা তিনটির তদন্ত করছে তারা। আর মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি।
তিনজন জামিনে মুক্ত
ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার ১৪ জনের মধ্যে ইতিমধ্যে তিনজন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। গত বছরের জুলাইয়ে সর্বশেষ জামিন পান ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর আগে জামিনে বের হন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ)।
সম্রাট ও জি কে শামীম হাসপাতালে
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছেন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাট ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম।
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আলী বলেন, সম্রাটের হৃদযন্ত্রে সমস্যা রয়েছে। আর জি কে শামীম মাসখানেক আগে অস্ত্রোপচার হওয়া তাঁর ডান হাতের পাত খুলতে এসেছেন। হাসপাতালে ১০-১২ দিন আগে তিনি আবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
আদালতে জমা পড়া ৩৫ মামলার অভিযোগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, আদালত অভিযোগপত্রগুলো গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে কিছু মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত