ইংল্যান্ডে নতুন আইন: অভিযোগ ছাড়াই ডিভোর্স!

| আপডেট :  ২৯ অক্টোবর ২০২১, ১০:৩২  | প্রকাশিত :  ২৯ অক্টোবর ২০২১, ১০:০১

এক: গণমাধ্যমে ‘নেগেটিভ’ সংবাদের পাঠক বেশী। মূলত: সংবাদ মানেই ব্যতিক্রম কিংবা নেগেটিভ কোনো ঘটনা। সাংবাদিকতা পেশায় এটা নিয়ে আমার সবসময় হতাশা কাজ করেছে। রিপোর্টার হিসেবে প্রতিনিয়তই অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতে হয় কোনো ব্যতিক্রম কিংবা নেগেটিভ কোনো ঘটনার তথ্য পাওয়া যায় কি-না। ইতিবাচক ঘটনার পাঠক যেমন কম, তেমনি মিডিয়ায় কভারেজও কম পায় সব ইতিবাচক ঘটনার সংবাদ। এজন্যই আমি পেশা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি অনেকবার। মাঝে মাঝে শিক্ষকতা পেশায় যাওয়ার চিন্তা করেছি, কিন্তু পরে মনে হয়েছে শিক্ষকতা পেশায় থ্রিলিং নেই। পরে সাংবাদিকতার পাশাপাশি যোগ দিয়েছিলাম বৃটিশ কাউন্সিলে। সেখানে আইইএলটিএস-এর মার্কার সহ আরো কিছু দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু সেখানেও টাকা আয় করা ছাড়া আমার কাছে তেমন এডভেন্সার লাগেনি। বৃটেনে এসে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলে পরীক্ষার কাজ এবং চ্যারিটি সংগঠনের সাথে কাজ করতে গিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ভালই লেগেছে। এরই মধ্যে সিটিজেন অ্যাডভাইস বু্রোতে আইনী কাজের অভিজ্ঞতা নিতে গিয়ে অনেক সাধারণ মানুষের পাশে দাড়ােনার সুযোগ ঘটে। সেখান থেকে পেশা পরিবর্তনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়া আর কি। এরই মধ্যে রয়টার্সে সাংবাদিকতার চাকুরি পেলেও আইন পেশায় প্রবেশের আকর্ষণে সবকিছু ছেড়ে এখন বৃটেনে আমি একজন ফুলটাইম আইনজীবী।

ভূমিকায় হেডলাইনের সাথে অসামঞ্জস্য লেখাটুকু পড়তে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনারা ধৈর্য হারাতে পারেন। কিন্তু, বাস্তবে আজকের লেখার বিষয়টিও কিছুটা হতাশাজনক আমার জন্য। কেননা ২০১৫ সাল থেকে একটু একটু করে আমি লন্ডনে আইন পেশায় কাজ করে আসছি। এই অল্প সময়ে সহস্রাধিক মানুষের ভিসা, পাসপোর্ট, ডিপোর্টেশন, হাউজিং, পারিবারিক সমস্যা, বানিজ্যিক লীজ, ক্রিমিনাল চার্জ এবং জমি ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধে আইনী সহায়তা দেয়ার সুযোগ হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করতে হয়েছে পারিবারিক সমস্যা (ডিভোর্স) সংক্রান্ত ক্লায়েন্টদের ক্ষেত্রে। ডিভোর্স ক্লায়েন্ট এলে আমার সবসময় ওই সাংবাদিকতা পেশার নেতিবাচক হতাশার কথা মনে পড়ে যায়। আর চলমান কোভিড ক্রাইসিসে এই পারিবারিক কলহ ও ডিভোর্সের মাত্রা এদেশে অনেকগুন বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

দুই: বিদ্যমান আইনে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসে ডিভোর্স করতে হলে আবেদনকারী মোট পাঁচটির যে কোন একটি বা একাধিক কারণের ওপর নির্ভর করতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কারন বা গ্রাউন্ডসটি হলো অযৌক্তিক আচরণ। এছাড়া ব্যভিচার / তৃতীয় কারো সাথে সম্পর্ক, ইচ্ছাকৃত পরিত্যাগ, দম্পতি দুই বছর পৃথক থাকা এবং পাঁচ বছর আলাদা থাকার প্রমাণ দিতে পারলে ডিভোর্স হতে পারে। এই পাঁচটি কারণের মধ্যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় – অযৌক্তিক আচরণ গ্রাউন্ডসেই ডিভোর্স হচ্ছে। কেননা দু’জন মানুষ একসাথে থাকলে কিছু অসামঞ্জস্য ও অযৌক্তিক আচরণ তাদের মধ্যে ঘটে। আর যখন তা বড় আকার ধারণ করে তখন এই গ্রাউন্ডসটি প্রমাণ করা সহজ হয়। ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের প্রমাণ থাকলে এটা একদমই সহজ হয়ে যায়। অন্য গ্রাউন্ডস্ যেমন – ভ্যাবিচার বা তৃতীয় ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক প্রমাণ করা একটু কঠিন। তেমনি অন্য তিনটি গ্রাউন্ডসও সময় সাপেক্ষ। এজন্য গত দেড় বছরে কোভিড মাহমারীর সময় অযৌক্তিক আচরণের গ্রাউন্ডসে অসংখ্য মানুষ ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসে ডিভোর্স আবেদন করেছে। এজন্যই চলমান সংকটে ডিভোর্স কোর্টও অসম্ভব ব্যস্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে। এরই মধ্যে আইনজীবী হিসেবে কিংবা কমিউিনিটিতে কিছুটা সংযুক্তির কারনে গত দুই বছরে সুযোগ হয়েছে বেশ কিছু পরিবারের সংকট সমাধানের এবং তারা দিব্যি সন্তান-পরিবার নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে। এসব অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে – কমিউনিটিতে যারা যতো বেশী ভাল সামাজিক কাজে জড়িত, তাদের জন্য পরিবার টিকিয়ে রাখার সুযোগটা ততো বেশী। আবার, অনেকে সামাজিকতা ও সন্তানদের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় বৈষম্য-নির্যাতন সহ্য করেও পরিবার টিকিয়ে রাখছেন অহরহ। এসবের বিরুদ্ধে অনেক সংগঠন সোচ্চার রয়েছে বৃটেনসহ বিশ্বজুড়ে। এসব সংগঠনের প্রচারণার ফসল হিসেবে ইতোমধ্যে পাশ হয়েছে ডিভোর্স, ডিসলিউশন এন্ড সেপারেশন বিল ২০২০। এই বিল আগামী এপ্রিল ২০২২ বাস্তবায়ন শুরু হবে।

তিন: আমার লেখার হেডলাইনটা মূলত: এই নতুন বিল নিয়ে। নতুন বিলে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসে ‘নো ফল্ট ডিভোর্স’ চালু করা হচ্ছে। অর্থাৎ, এই আইন অনুযায়ী আবেদনকারী ডিভোর্স চাইলে বর্তমানে প্রচলিত কোনো গ্রান্ডস্ প্রমাণ করতে হবে না। এই বিল চালু হওয়ার কথা ছিল গত সেপ্টেম্বরে। কিন্তু সরকার এটি পিছিয়েছে এবং ইহা বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী এপ্রিল ২০২২। বিলটি নি:সন্দেহে একটি বৈষম্য ও নিপিড়নহীন এবং যৌক্তিক পরিবার গঠনে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো তাদের জন্য, যারা এই আইনের স্পিরিট বুঝতে অক্ষম হবেন এবং মিসইউজ করবেন।

এই আইন অনুযায়ী, একটি পক্ষকে দোষারোপ করার পরিবর্তে, একটি দম্পতি বিবাহবিচ্ছেদ পেতে চাওয়ার একমাত্র কারণ হিসাবে পারস্পরিকভাবে ‘অপ্রতিরোধ্য ভাঙ্গন’ উল্লেখ করতে পারবেন। এটি একটি যৌথ বিবৃতিতে বা একজন ব্যক্তির দ্বারা করা যেতে পারে। শুধু আবেদনকারী যদি উল্লেখ করেন যে, অপরপক্ষের অযৌক্তিক আচরণের কারণে তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে – কোনো প্রকার প্রমাণ প্রদান না করেই ডিভোর্স সম্পন্ন করা যাবে।

ডিভোর্সের আবেদন অনলাইনে করা যাবে। এখানে ডিফেন্সের সুযোগ নেই, যেহেতু কোনো প্রকার অভিযোগ ছাড়াই ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। সন্তান কিংবা সম্পত্তি বিষয়ে লিটিগেশনের দরকার হলে তারা পৃথক আবদেন করেবন।
একবার আবেদন করা হয়ে গেলে, আবেদনকারীকে শর্তসাপেক্ষ আদেশের জন্য আবেদন করার জন্য উত্তরদাতাকে আবেদনের সাথে পরিবেশন করা থেকে ২০ সপ্তাহ অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়কাল উভয় পক্ষকে তাদের বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটানোর অনুমতি দেবে। শর্তসাপেক্ষ আদেশের তারিখ থেকে ছয় সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরে আবেদনকারী বিবাহবিচ্ছেদ বা বিলুপ্তির চূড়ান্ত আদেশের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

ডিভোর্সের এই নতুন নিয়ম চালুর বিষয়টি বাংলাদেশী কমিউিনিটিতে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আগ্রহী অনেকেই যেন এই ‘এপ্রিল ডেডলাইন’ এর অপেক্ষায়। নতুন এই আইনের স্পিরিট নিয়ে কমিউনিটিতে ব্যাপক সচেতনতা জরুরী, নইলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ইংল্যান্ড এই ওয়েলসের বাংলা কমিউনিটিতে। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত কম সচেতন পরিবারগুলোতে ঝুঁকির মাত্রা বাড়বে, আর এ ঝুঁকিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে ইউরোপ থেকে এসে এখানে বসবাসরত বাংলাদেশী কিংবা এশিয়ান পরিবারগুলো। একমাত্র সচেতনতামূলক প্রচারণাই পারে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে কমিউনিটিকে রক্ষা করতে।

এম মাহাবুবুর রহমান

লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী।

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত