বাইডেন-জিনপিং বৈঠক থেকে যে বার্তা পেলো বিশ্ববাসী

| আপডেট :  ১৯ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৩০  | প্রকাশিত :  ১৯ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৩০

যারা বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে এই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে যে, বর্তমানে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো মূলত দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি গ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে; অন্যটি চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে। এর মধ্যে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে থাকা দেশগুলো হলো, ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারত। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সবসময় একটা উত্তেজনা লেগেই থাকে। যা চরম আকার ধারণ করেছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের শেষ বছরে।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসওএএস চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক স্টিভ সাং টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘আমরা আগে ভাবতে পছন্দ করতাম যে, এই সমস্যাটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কারণেই সৃষ্টি। কিন্তু এখন এটা বেশ স্পষ্ট যে, এটি কেবল নির্দিষ্টভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের সমস্যা ছিল না। বরং এটি দুই দেশের কাঠামোগত সমস্যা।’

অবশ্য গত জানুয়ারিতে বাইডেন হোয়াইট হাউজের ক্ষমতায় বসার পর থেকে চীনের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও তাইওয়ান, উইঘুর, ইরানের পরমাণু চুক্তি, হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মানবাধিকার ইস্যুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে। তার মাঝেই গত ১০ মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। যার সর্বশেষটি যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত সোমবার রাতে উভয় নেতার মধ্যে ভার্চুয়াল আলোচনা। এরপর থেকেই কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভবত মতবিরোধগুলোকে একপাশে রেখে আপাতত চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সুযোগ খুঁজছে।

জো বাইডেন-শি জিনপিং ভার্চুয়াল সামিটের পূর্ব কথা
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে আয়োজিত জাতিসংঘের সিওপি-২৬ জলবায়ু সামিটে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেইজিং ও ওয়াশিংটন ঘোষণা দেয় যে, তারা আসন্ন দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মিথেন গ্যাস ও কার্বন নিঃসরণ কমানোসহ জলবায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করবে। বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে প্রথমে এই উদ্যোগটি এসেছে। যেটিকে ভবিষ্যতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আরও সহযোগিতামূলক বিভিন্ন কাজের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

করোনায় কোন টিকা কতটা কার্যকরকরোনায় কোন টিকা কতটা কার্যকর
অবশ্য, এই সামিটে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সরাসরি উপস্থিত থাকেননি। তার হয়ে চীনের অন্য প্রতিনিধিরা ছিলেন। অবাক করা বিষয় হলো, এই সামিটের এক সপ্তাহেরও কম সময়ের ব্যবধানে ভার্চুয়াল সামিটে অংশ নিলেন বিশ্বের প্রভাবশালী এই দুই প্রেসিডেন্ট। যেখানে তাইওয়ান, হংকং, উইঘুর ও মানবাধিকার ইস্যুর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা নিয়েও আলোচনা করেছেন তারা। তাই এটিকে উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্কের বরফ গলার প্রাথমিক ধাপ বলছেন কেউ কেউ। যদিও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, ভার্চুয়াল এই আলোচনায় তেমন বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। কেবল সাংবাদিকদের একে অন্যের দেশে আরও সহজে যাতায়াত করার অনুমতি দিতে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন। এর বাইরে আর কোনো বড় ইস্যুতে তারা একমত হয়নি।

বাইডেনকে পুরনো বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন শি জিনপিং
ভার্চুয়াল মিটিংয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পুরনো বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট। গত এক যুগে বিভিন্ন সময় অসংখ্যবার এক সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন এই দুই নেতা। যার মধ্যে ২০১১ সালে বেইজিংয়ের একটি দোকানে তারা নুডলস খেয়েছিলেন। তখন তারা দুজনই নিজ নিজ দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

চীনের দাবি তারা জয়ী হয়েছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলছে ভিন্ন কথা
পুরনো সখ্যের বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই দুই নেতার আলোচনায় বিস্তৃত বিতর্কিত বিষয়গুলোও কভার পেয়েছে। বাইডেন জিনজিয়াং, তিব্বত ও হংকংয়ে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে বেইজিংয়ের অন্যায় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কেও তুলে ধরেন।

হোয়াইট হাউজের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে তাইওয়ানের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তাইপের দিকে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী সামরিক অবস্থানের লক্ষণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ওয়াশিংটন। বিশেষ করে সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশসীমায় চীনের পিপলস লিবারেশন এয়ার ফোর্সের অনুপ্রবেশের কারণে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে।

তবে পৃথক বিবৃতিতে ইস্যুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে বেইজিং। শি জিনপিং সতর্ক করে বলেছেন, ওয়াশিংটন যেন নতুন শীতল যুদ্ধের দিকে পা না বাড়ায়। পাশাপাশি তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে ‘আগুনের সঙ্গে খেলা’ বলে মন্তব্য করেন চীনা প্রেসিডেন্ট। চীনের সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবরে দাবি করা হয়, বৈঠকে নাকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তিনি তাইওয়ানের স্বাধীনতা সমর্থন করেন না। অর্থাৎ তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের সঙ্গে মৌনভাবে একমত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর এটিকেই সামিটে নিজেদের বিজয় বলে দাবি করছে বেইজিং।

তবে পরদিন বিষয়টির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে হোয়াইট হাউজ। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে স্বাধীনতার কথা উল্লেখই করেননি প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তাইওয়ান ইস্যুতে তিনি বলেছেন, এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চায়না’ নীতিকে সমর্থন করে। ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করেছেন বাইডেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি স্বাধীনতা ইস্যুতে তাইওয়ানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা নই। অর্থাৎ আমরা স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছি না। আরও স্পষ্ট করে বলছি, আমরা তাইওয়ান আইনকে সমর্থন করি। তাইপেকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক চায়না’ নীতি হলো, তাইওয়ানকে চীনের একটি অংশ বলে স্বীকার করে ওয়াশিংটন। কিন্তু তাই বলে কখনোই দ্বীপরাষ্ট্রটির ওপর চীনের কর্তৃত্ব চায় না। বরং তাইপের সঙ্গে ওয়াশিংটনের আন-অফিসিয়াল দ্বিাপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখে। পাশাপাশি তাইওয়ান সম্পর্ক আইনের অধীনে দ্বীপরাষ্ট্রটির সার্বভৌমত্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সমসময় পাশে থাকবে।

কোন দিকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক
হিনরিক ফাউন্ডেশনের সিনিয়র গবেষক স্টিফেন ওলসন সিএনবিসিকে বলেন, বৃহত্তর সম্পর্কের জন্য এখন দেখার বিষয় হলো, বিশ্ব নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উদ্ঘাটিত ধীর গতির সংঘর্ষকে গঠনমূলকভাবে পরিচালনা করতে পারে কি না। দেশ দুটি এখনো কঠোর এবং অমীমাংসিত পার্থক্য এর মুখোমুখি, যা গভীরভাবে আবদ্ধ। বৈঠকের পর তাদের মধ্যে (বাইডেন-শি) দ্বন্দ্ব কমবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

স্টিফেন ওলসন বলেন, ‘কোনো দেশই হারিয়ে যাবে না। কোনো দেশই অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেবে না। বুদ্ধিমানের কাজ হবে উভয় পক্ষের (যুক্তরাষ্ট্র-চীন) ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনার সহাবস্থানের জন্য যুক্তিসঙ্গত উপায় খুঁজে বের করা।’ ওলসন ব্যাখ্যা করছেন যে, চীন এমন একটি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কম শক্তিশালী দেশ হিসেবে দেখছে, যখন বেইজিং বিশ্বব্যাপী মঞ্চে আরও আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। অন্যদিকে, ওয়াশিংটন চীনের উত্থানের আশপাশের পরিস্থিতিকে তাদের নিজেদের স্বার্থের বিরোধী হিসেবে দেখছে। এক্ষেত্রে চীনকে আরও জোরপূর্বক মোকাবিলা ও চ্যালেঞ্জ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

যাইহোক, বৈঠকের সময় শি জিনপিং বলেছেন যে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি নতুন যুগ। আর এই সম্পর্কটিকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের এখন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং হার-জিত সহযোগিতার নীতি মেনে চলতে হবে।

বাইডেন-শি বৈঠক সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈঠকে কোনো সুস্পষ্ট অর্জন আসেনি ঠিকই, কিন্তু এটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সাহায্য করতে পারে। করোনা আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত চীনের বাইরে যাননি শি জিনপিং। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সাড়ে তিন ঘণ্টা দীর্ঘস্থায়ী এই সামিট নেতাদের (বাইডেন-শি) অনেক বেশি জড়িত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

আসলে বাসভাড়া বাড়লো কতআসলে বাসভাড়া বাড়লো কত
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ চায়না গ্লোবাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অ্যান্ড্রু মেরথা টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘বৈঠকটি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর নতুন সম্পর্ক। যা দেশ দুটিকে একটি সমান পদক্ষেপে এনে দাঁড় করিয়েছে, অন্তত অপটিক্যালি।’

যদিও পরাশক্তিরা যেসব বিষয়ে একমত নয়, এমন তালিকা দীর্ঘ ও ভবিষ্যতে সংঘর্ষের আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু সমস্যায় দেশ দুটির সাম্প্রতিক সহযোগিতা ইস্যু এক সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের আরও ভালো উপায়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সে কথাই বললেন স্টিভ সাং। তিনি বলেন, ‘তারা একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে যেন একে অন্যের সঙ্গে আরও গঠনমূলক উপায়ে কাজ করতে পারে। তারা এখনো কোনো উপায় খুঁজে পায়নি, কিন্তু তারা চেষ্টা করছে।’

ভালো কিছুই আশা করতে পারে বিশ্ব
গত জানুয়ারিতে বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে এই প্রথম এতটা দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন বাইডেন ও শি জিনপিং। গত কয়েক বছরে মার্কিন-চীন সম্পর্ক কেবল খারাপই হয়েছে। বাণিজ্য ও প্রযুক্তি নীতি থেকে শুরু করে মানবাধিকার, কোভিড-১৯ মহামারির উৎপত্তিসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞা ও কথা কাটাকাটি হয়েছে।

চীনে সাবেক মার্কিন বাণিজ্য সচিব এবং রাষ্ট্রদূত গ্যারি লক সিএনবিসির এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দুই নেতার এই বৈঠক ভালো কিছুরই ইঙ্গিত দেয়। এখান থেকে বিষয়গুলো কেবল ভালো হতে পারে। দুই দেশেরই একে অন্যের প্রয়োজন আছে। এছাড়া বিশ্বের অনেক সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের সহযোগিতা এবং এক সঙ্গে কাজ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত