ময়মনসিংহে ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা অনুষ্ঠিত (ভিডিওসহ )

| আপডেট :  ১৪ জানুয়ারি ২০২২, ১১:২২  | প্রকাশিত :  ১৪ জানুয়ারি ২০২২, ১১:০১

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি: কোভিড-১৯ আক্রান্তের হার ক্রমবর্ধমান হওয়ায় উন্মুক্ত স্থানে সর্ব প্রকার জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকলেও ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া

উপজেলায় লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটায় তালুক-পরগনার সীমানায় লাখো মানুষের সমাগমে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো ঐহিত্যবাহী হুম-গুটি খেলা।

ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের জমি পরিমাপের বিরোধের মীমাংসা করতে আয়োজন হয়েছিল এই খেলার। পরবর্তীতে আমন ধান কাটা শেষ, বোরো ধান আবাদের আগে প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য জমিদারদের এই পাতানো খেলা চলছে আড়াইশো বছরেরও অধিক সময় ধরে।

২৫০ বছর আগে মুক্তাগাছার রাজা শশীকান্ত আচার্য্যের সঙ্গে ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তখনকার দিনে তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের জমিতে দুই নীতির কারণে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই বিরোধ মীমাংসা করার জন্য লক্ষ্ণীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে তালুক-পরগনার সীমানায়’এই গুটি খেলার আয়োজন শুরু করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’। মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয় জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায়। স্থানীয় মোড়ল পরিবার বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে এই খেলার আয়োজন করে আসছে।

গুটি হচ্ছে একটি পিতলের তৈরি ৪০ কেজির গোলাকার বল। এ বল নিয়ে মাঠে লাখো মানুষের কাড়াকাড়ি হয় এর দখল নিয়ে। সবার মুখে উচ্চারিত হয় “জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে হেইও…।

খেলাটি অনুষ্টিত হয় পৌষ মাসের শেষ দিনে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুহুরা। এই দিনেই যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই খেলা। বিকেল সোয়া ৪টায় শুরু হয় এই খেলা। খেলা চলে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত । কোন কোন বছর পরেরদিন পর্যন্ত খেলা চলার রেকর্ডও আছে। রাতের বেলায় টর্চ লাইটের সাহায্যে চলে এ খেলা।
ফুলবাড়িয়া সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষ্মীপুর ও ১০ মাইলের মাঝামাঝি “বড়ই আটাবন্ধ” নামক বড় মাঠ হলো খেলার কেন্দ্র স্থল। এই স্থানটি মুক্তাগাছা-ত্রিশাল জমিদার আমলে তালুক বনাম পরগনার সীমানা ছিল।

খেলাটির নিয়ম,১ মণ ওজনের পিতলের তৈরি গুটি করায়াত্ত করে নিজ গ্রামে নিয়ে গুম করা পর্যন্ত চলে এই খেলা। শুরুতে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ভাগবাটোয়ারা করে খেলা শুরু হলেও পরে আর কোন দিক থাকেনা।একেক এলাকার একেকটি নিশানা থাকে এবং ঐ নিশানা দেখে বুঝা যায় কারা কার পক্ষের লোক। গুটিটি কোন দিকে যাচ্ছে তা চিহিৃত করা হয় নিশানা দেখেই। এই গুটিটি মাঠের আসার পরপরই তার উপর ঝাপিয়ে পরে লাখো জনতা।দখল নিতে শুরু হয় টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি, ধস্তাধস্তি। গুটিটি নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়।লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটায় খেলা শুরু হলেও আস্তে খেলাটি ছড়িয়ে পড়ে ৫/৮ কিলোমিটার দূরের গ্রামেও। গুটিটি গুম না হওয়া পর্যন্ত চলে এ খেলা। মানুষের ভিড়ে কে গুটি নিয়ে দৌড় দিয়ে গুম করে কেউ জানেনা। খেলায় কোন রেফারি থাকেনা, খেলোয়াড়রাই থাকেন এ খেলার বিচারক। গুটি নিয়ে দলের কাড়াকাড়ি,আপন আপন গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং যারা নিতে পারবে তারাই হবে বিজয়ী।
খেলোয়ায় অংশগ্রহণকারীরা হলেন
ময়মনসিংহ সদর উপজেলা, মুক্তাগাছা উপজেলা, ত্রিশাল উপজেলা ও ফুলবাড়িয়া উপজেলার খেলোয়াড়রা অংশগ্রহণ করে।

অতি প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্ণীপুর, বড়ইআটা,ভাটিপাড়াবালাশ্বর,শুভরিয়া,কালীবাজাইল,তেলিগ্রাম,সারুটিয়া,গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা, ফুলবাড়িয়া পৌর সদর, আন্ধারিয়াপাড়া, জোরবাড়ীয়া, চৌদার, দাসবাড়ী,কাতলাসেনসহ আশে-পাশের ১৪ থেকে ১৫টি গ্রামে উৎসব শুরু হয় এই খেলাকে কেন্দ্র করে। এই খেলা উপলক্ষ্যে আশেপাশের গ্রামগুলোতে নাইওর আসে বাড়ির বউ এবং কন্যারা। মেজবানির জন্য করা হয় গরু খাসি জবাই দেওয়া হয়। ঘরে ঘরে পিঠা পুলির উৎসব শুরু হয়। এই খেলা উপলক্ষ্যে নতুন নতুন জামাও কেনে এই অঞ্চলের লোকেরা।

এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, খেলাটি ঐতিহ্যবাহী। প্রতি বছরই এই দিনে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত বছর থেকেই তাদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে। তারপরেও তারা খেলার আয়োজন করেছে।

ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত