পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ফের উত্তাপ রাজনীতি

| আপডেট :  ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:১১  | প্রকাশিত :  ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:১১

নির্বাচন সামনে রেখে আবারও শুরু হয়েছে রাজপথ দখলের লড়াই। বিরোধী দলকে এককভাবে রাজপথে কোনো শোডাউনের সুযোগ দিতে নারাজ ক্ষমতাসীন দল। বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচির জবাবে একই দিন পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আগামীকাল বুধবার ঢাকাসহ দেশের ১০ বিভাগীয় শহরে গণঅবস্থান কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি সফল করতে জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে এ অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে বিরোধী দলগুলো। অন্যদিকে, বিরোধী জোটের এ কর্মসূচির দিন ‘সতর্ক পাহারায়’ থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সম্ভাব্য সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ঠেকাতে ‘শান্তি সমাবেশ’ কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে থাকবেন দলটির নেতাকর্মীরা। প্রধান দু’দলের এ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতি। দু’পক্ষের এ মুখোমুখি অবস্থানে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা।

বিশ্নেষকরা বলছেন, সরকার ও বিরোধী দল সবার উচিত সংঘাত এড়িয়ে চলা। নির্বাচনের এখনও এক বছর বাকি। এখনই রাজপথ দখল নিয়ে সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়লে তা কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না। প্রতিটি দলের সংবিধান অনুযায়ী সভা-সমাবেশ করার মৌলিক অধিকার রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করলে সাধারণ মানুষের আরও কষ্ট বাড়বে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির সমাবেশগুলোতে মানুষের ঢল দেখে জনরোষের ভয়ে বিনা ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার ভয় পেয়ে গেছে। তাই তারা বিএনপির কর্মসূচির দিন পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে অবৈধ সরকারের গদি রক্ষার চেষ্টা করছে। কিন্তু লাভ হবে না। জনতার ঢেউয়ে এসব বাধা উড়ে যাবে। শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, বিএনপি ও তার মিত্ররা আন্দোলনের নামে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। আর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া যে কোনো সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও দায়িত্ব মানুষের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সরকার ও দল সেই দায়িত্ব পালনে যা করার দরকার, সবই করবে।

সহিষ্ণুতা প্রয়োজন- বললেন বিশ্নেষকরা :সুজন সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার চলাফেরা, সভা-সমাবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করা- সংবিধান অনুযায়ী এগুলো মৌলিক অধিকার। এগুলোতে বাধা দেওয়া সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এগুলো কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার প্রতিফলন। এ ধরনের আচরণ দেশ, গণতন্ত্র ও দলের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক নয়। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ দখল বা শক্তি প্রদর্শনই সমস্যার সমাধান হবে না; সংকট উত্তরণের পথ বের করতে হবে। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সংঘাত-সহিংসতাময় বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রধানতম উপায় হচ্ছে, একে অপরের প্রতি গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ দেখানো এবং পরমতসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতিও প্রত্যেককে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।

তিনি বলেন, তবে বিএনপি দীর্ঘদিন পর মাঠে নামার সুযোগ পেলেও তাদের দলের মধ্যেও কিন্তু উগ্রপন্থি রয়েছে, যারা কর্মসূচির নামে পরিস্থিতি আরও অসহনশীল করে তুলছে। কাজেই সরকারি দলকে যেমন সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে, তেমনি বিএনপিকেও এমন অপতৎপরতা থেকে সরে আসতে হবে। পাশাপাশি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে হবে।

গণঅবস্থানে মানুষের ঢল নামাতে চায় বিএনপি :নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে গণঅবস্থানে মানুষের ঢল নামাতে চায় বিএনপি। ঢাকায় বিএনপি ঘোষিত গণঅবস্থান কর্মসূচি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সকাল ১১টা থেকে শুরু হবে। চার ঘণ্টার এ অবস্থান কর্মসূচিকে সমাবেশে রূপ দিতে এরই মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করেছেন দলটির নেতাকর্মী। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড, এমনকি ইউনিট পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা শেষ করা হয়েছে। একইভাবে দলটির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারাও তাঁদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি শেষ করেছেন।

বিএনপি নেতারা জানান, বাংলাদেশের মানুষ তার মালিকানা, ভোটাধিকার, আইনের শাসন এবং জীবনের নিরাপত্তা ফিরে পেতে চায়। এ জন্য অবৈধ ফ্যাসিস্ট, দখলদার, অনির্বাচিত ও নির্যাতনকারী সরকারকে বিদায় নিতে হবে। আর তাদের বিদায়ের জন্য বিএনপিসহ গণতন্ত্রকামী অন্যান্য রাজনৈতিক দলও যুগপৎ আন্দোলন করছে। জনগণের সম্মিলিত আন্দোলনে এই সরকারের অবশ্যই বিদায় ঘটবে।

ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও এ কর্মসূচি সফল করতে কেন্দ্র থেকে টিম গঠন করে দেওয়া হয়েছে। দলের সিনিয়র নেতাদের এসব বিভাগের টিমপ্রধান করে বিভাগীয় নেতা থেকে শুরু করে প্রতিটি জেলা ও মহানগর নেতাদের এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জানান, কেন্দ্র থেকে যে টিম গঠন করা হয়েছে, এর সদস্যরা আজকের মধ্যেই ওই সব বিভাগীয় শহরে যাচ্ছেন। তাঁদের উপস্থিতিতে গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কুমিল্লা বিভাগের দলনেতা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চট্টগ্রামে মো. শাহজাহান, ময়মনসিংহে আবদুল আউয়াল মিন্টু, ঢাকায় ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, খুলনায় শামসুজ্জামান দুদু, রাজশাহীতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, ফরিদপুরে দলের যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সিলেটে অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বরিশালে হাবিব-উন-নবী খান সোহেল এবং রংপুরে হারুন-অর-রশিদ।

বিএনপি ছাড়াও সাতদলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, ১২ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, জামায়াতে ইসলামী, মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, চার দলের জোট গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য এবং ১৫ সংগঠন সমন্বয়ে সমমনা গণতান্ত্রিক জোটের নেতাকর্মী ঘোষিত গণঅবস্থান কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে একই সময়ে তাঁরা এ কর্মসূচি পালন করবেন।

১২ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা। গতকাল মতিঝিলের দিলকুশায় জোটের শরিক এনপিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন এবং পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জোট নেতারা সরকার পতনে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। উপস্থিত ছিলেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতা ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী, জাগপার সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমান, ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি প্রমুখ।

সমাবেশ করবে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ :বিএনপির গণঅবস্থানের দিন সারাদেশে সতর্ক অবস্থানে থাকবেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তবে ঢাকাকে গুরুত্ব দিয়ে এদিন রাজধানীতে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে ক্ষমতাসীন দলটি। সকাল থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে নেতাকর্মীকে মিছিল ও ‘সতর্ক পাহারায়’ থাকতে বলা হয়েছে। নাশকতার আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ামাত্র প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি নেতাকর্মীও প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ মিরপুরে এবং মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সকাল থেকে তারা পাহারায় থাকলেও দুপুরের পর মিছিল নিয়ে ঘোষিত সমাবেশস্থলে যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে দলটির। দুটি সমাবেশেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন।

সমাবেশে লোকসমাগমের জন্য ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডভিত্তিক কর্মিসভা, প্রস্তুতি সভা করেছে। এসব সভা থেকে দেওয়া হয়েছে নানা দিকনির্দেশনা। বিএনপির জমায়েত বড় না হলে কিংবা বিএনপি টানা অবস্থানের দিকে না গেলে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক মিছিল-সমাবেশ করবে। পরিস্থিতি ভিন্ন হলে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তরের অধীন ২৬টি থানা, ৫৪টি ওয়ার্ড, একটি ইউনিয়ন- সবটাতেই নেতাকর্মীর পাহারা বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে নিজ নিজ থানা ও ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে অবস্থান নেবেন নেতাকর্মী।
অন্যদিকে, মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অধীন ৭৫টি ওয়ার্ডে ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে নেতাকর্মীকে সতর্ক পাহারায় বসানো হবে। আর ২৪টি থানার মূল পয়েন্ট কিংবা মোড়ে থানা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা অবস্থান নিয়ে গোটা পরিস্থিতি তদারক করবেন। বিশেষ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টনসহ গণঅবস্থানের স্পটগুলোতে সতর্ক নজরদারিতে রাখা হবে। কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পরিস্থিতি মনিটরিং করবেন; প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দেবেন। ওয়ার্ড ও থানাওয়ারি পাহারা তদারকি করতে মহানগর দক্ষিণের ৭৫ নেতাকে ৭৫টি এলাকা ভাগ করে দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিএনপির অতীত কর্মকা তাঁদের সতর্ক অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। ১১ জানুয়ারিতেও আওয়ামী লীগ সতর্ক অবস্থানে থাকবে।

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত