যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ভারত-পাকিস্তান, দ. এশিয়ার অন্য দেশগুলো মধ্যস্থতা করছে নাকি পক্ষ নিচ্ছে

গত রোববার (২২ এপ্রিল) কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে উত্তেজনার পারদ মুহূর্তের মধ্যে চরমে পৌঁছে যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দেয়ার অভিযোগ আনছে ভারত। অন্যদিকে, এই হামলাকে নয়াদিল্লির শাসনের প্রতি সশস্ত্র গোষ্ঠীর দীর্ঘ ক্ষোভের প্রকাশ বলছে ইসলামাবাদ। সেই সঙ্গে কাশ্মীর সংকটকে ভয়াবহ মাত্রায় নিয়ে যাওয়া এবং কাশ্মীর শাসনে নয়াদিল্লির ব্যর্থতাকেই সশস্ত্র হামলার কারণ বলছে ইসলামাবাদ।
ভারত-পাকিস্তান যদি সরাসরি যুদ্ধ বা পারমাণবিক সংঘাতে জড়ায়, তাহলে এর প্রভাব শুধু এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়া ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা, মানবিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হবে। গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রাণ হারাতে পারে—যা এক অভাবনীয় মানবিক বিপর্যয়। তবে এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তারা কি কোনো পক্ষ নেবে, নাকি সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বলিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে।
যেকোন সংঘাতে পক্ষ নেয়ার মানে হলো দ্বন্দ্বকে উসকে দেয়া এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধকে সমাধান মনে করা। এতে কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে প্রতিবেশী সব দেশই। যুদ্ধপ্রবণ অঞ্চলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য দ্রুত কমে যায়, যার নেতিবাচক প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতির ওপরে পড়ে।
অন্যদিকে, সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বের করতে সহায়তা করে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। নিরপেক্ষ অবস্থান আন্তর্জাতিক মঞ্চে যেকোন দেশের মর্যাদা বাড়ায় সেই সঙ্গে দেশটির অর্থনৈতিক সুযোগ বাড়ে। এটি সার্বভৌম নিরাপত্তা ও নৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে সহায়তা করে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছালে বিশ্বের বেশ কয়েকটি শক্তিধর দেশ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার আগ্রহ প্রকাশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলাদা আলাদা ফোনালাপের পরিকল্পনা করেছেন, যাতে উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানানো যায়। যুক্তরাষ্ট্র উভয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং দায়িত্বশীল সমাধানের জন্য উৎসাহিত করছে। যদিও ওয়াশিংটন ভারতের প্রতি কিছুটা সমর্থন জানিয়েছে, তবে পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে সমালোচনা না করে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে ।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, ‘আমরা উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং তাদেরকে পরিস্থিতি আর খারাপ না করার আহ্বান জানিয়েছি।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে আলাদা আলাদা ফোনালাপ করেছেন। তিনি উভয় পক্ষকে সংঘাত এড়াতে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা প্রস্তাব করেছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সোমবার (২৮ এপ্রিল) ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এই অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসুক এবং উভয় পক্ষ সংযম প্রদর্শন করুক।’
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত। তেহরান উভয় দেশকে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সরাসরি আহ্বান জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টে বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা আমাদের দেশের ভারতীয় ও পাকিস্তানি সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।’ তিনি উভয় সম্প্রদায়কে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং বলেন, ‘কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত।’
চীন, ইসরায়েল, জাপান ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ পেহেলগাম হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভূমিকা: বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে সংঘর্ষ-সংঘাত এবং যুদ্ধের বিপক্ষে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। অতীতে বাংলাদেশ যেকোনো আঞ্চলিক উত্তেজনায় শান্তি ও আলোচনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ ও সার্কের মাধ্যমে সক্রিয় কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়নি, বরং নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, আমাদের (বাংলাদেশ) অবস্থান খুব পরিষ্কার—আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি চাই। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই না কোনো বড় ধরনের সংঘাত হোক।’ তবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা নিজেরা কোনো উদ্যোগ নিতে চাই না। যদি কোনো পক্ষ চায়, তাহলে আমরা মধ্যস্থতা করতে পারি।’
নেপাল দীর্ঘদিন ধরেই অ-পক্ষপাতদুষ্ট (নন-অ্যালায়েন্স) পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। যুদ্ধের সম্ভাব্যতা নেপালের স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ফলে নেপাল যুদ্ধবিরোধী বিবৃতি দিতে পারে এবং আলোচনার আহ্বান জানাতে পারে।
ভুটান ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিতে অনেকাংশে ভারতের উপর নির্ভরশীল। সে জন্য সরাসরি পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান না নিলেও, ভুটান ভারতের পক্ষেই কূটনৈতিক অবস্থান নিতে পারে। তবে তা হবে নীরব ও সংযত ভাষায়।
শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের সঙ্গেও তাদের কিছু কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক আছে। শ্রীলঙ্কা উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাবে এবং যুদ্ধ এড়াতে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আলোচনা চাইবে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জলবায়ুবিষয়ক ইস্যুতে মালদ্বীপ সক্রিয়। ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে বৈরিতায় রূপ নিয়েছে। তা সত্ত্বেও মালদ্বীপ যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেবে এবং ভারতের দিকে কৌশলগতভাবে ঝুঁকে থাকতে পারে, যদিও প্রকাশ্যে তা বলার সম্ভাবনা কম।
সার্কের সদস্য হিসেবে এই ছোট দেশগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে আঞ্চলিক শান্তি রক্ষা করা। যুদ্ধ যেন শুরু না হয়, সেজন্য তারা প্রকাশ্যে বা পরোক্ষভাবে আলোচনা, শান্তি ও কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে কাজ করতে পারে। এই সংকটে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হতে পারে, যদি সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব নিতে চায়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য পক্ষ নেয়ার চেয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখা অধিক যুক্তিসংগত। এটি কেবল আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখে না, বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের মর্যাদা বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এটি একটি কৌশলগত ও নৈতিকভাবে বিশ্ব রাজনীতি কার্যকর ভূমিকা রাখার একটি সূবর্ণ সুযোগ।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত