‘সমাজের চোখে ‘নষ্টা মেয়ে’ টিকতে পারেননি’

| আপডেট :  ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৪  | প্রকাশিত :  ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৪

আসল মানুষটা আধারে হারায়, মুখবাজি মানুষটা যুদ্ধের সাধ লয়…

যুদ্ধ করে কারা আর যুদ্ধের নাম বেইচা খায় করা…

বুকের তাজা রক্ত, আহত, পঙ্গু যারা, আজও ভাল নেই তারা…

সাভারের হেমায়েতপুর। আলমনগর হাউজিং পেরিয়ে একটু পশ্চিমে হাতের বাঁয়ে সনি ফিলিং স্টেশনসংলগ্ন তিন রাস্তার মোড়। সেখান থেকে সোজা দক্ষিণে যাদুর চর পেরিয়ে মধুর চর বাজারের তিন রাস্তার মোড়। পূর্ব দিকের রাস্তাটা ধরে একটু এগোলে বেলালের অটোরিকশার গ্যারেজ।

এরপরই হাতের ডানে লোহার গ্রিল দেওয়া গেট। ফোন করতেই বেরিয়ে এলেন হালকা পাতলা এক বৃদ্ধা। নিয়ে গেলেন ভেতরে।
ফিরোজার যুদ্ধ এখনো চলছেএকচিলতে উঠান।

উঠান ঠিক না—ধুলাবালির ফাঁকা জায়গা। ময়লা-আবর্জনায় ভরা। সঙ্গে টিনশেডের দুই কক্ষের একটা ঘর। মেঝেতে পুরনো তোশক আর চাদর পাতা।

সেখানে বসে ৯-১০ বছরের একটি মেয়ে পড়ছে। সেখানেই বসলাম। বৃদ্ধার নাম ফিরোজা বেগম—একাত্তরের নির্যাতিতা, গ্লানি ঢাকতে যাকে আমরা বীরাঙ্গনা বলি। পাক হানাদাররা তার শিশুসন্তান কেড়ে নিয়েছে। নিজেও নির্যাতন সয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরও যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এখন তার শুকনা মুখ, ভাঁজ পড়া চামড়া, ঘোলাটে চোখ। কিন্তু সেই চোখে তাকানোর সাহস হচ্ছিল না; কী করে কথা তুলি! অবশ্য বেশি তর সইতে হলো না। একাত্তরে কোথায় ছিলেন? এতটুকু বলতেই খুলে দিলেন দুঃসহ সেই স্মৃতির ঝাঁপি।

গ্রামে এলো যমদূত

মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার হযরত কইয়ারা গ্রামে শিকড়। কিন্তু ফিরোজার ঠিকানা যেন স্থায়ী হয়নি আজও। স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগেই জন্ম আরো তিন ভাই-বোনের। সংসারে খরচ বাড়ে। ওই সময় প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন বাবা। শয্যাশায়ী বাবার চিকিৎসা, ছোট ভাই-বোনদের বাঁচাতে মায়ের সঙ্গে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন শুরু করেন ফিরোজা। তার জীবনে সত্যিকারের দুঃখের শুরু ১৯৭১ সালে। তত দিনে সংসার গড়েছিলেন। মা হয়েছিলেন সত্তরের প্রথম প্রহরে। কোল আলো করে এসেছিল চাঁদের মতো পুত্র। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল। তখন একাত্তরের মাঝামাছি। একদিন তার সামনে যমদূতের মতো হাজির হয় পাকিস্তানি সেনারা।

অন্য সবার মতো আগুন দেয় তার ঘরেও। মিলিটারি আসার খবরে অন্যদের সঙ্গে মামাবাড়ি পালাতে চেয়েছিলেন। পারেননি। পরে লুকিয়ে রইলেন আড়ালে। কিন্তু গুটি গুটি পায়ে হাঁটা ছেলেকে সঙ্গে নিতে পারেননি ফিরোজা! চার-পাঁচজন নরপশু চোখের সামনে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে ছোট্ট সেই শিশুকে! হৃদয় খুঁড়ে বেদনা-জাগানিয়া সেই ঘটনার কথা বলতে গলা ধরে আসে এই মায়ের, ‘যেকালে পশ্চিমারা আইছে, হেকালে আমার বয়স ১৬ বছর আছিল। মিলিটারি আহনের খবর পাইয়া বিল পার হয়া মামাবাড়ি যাইতে লইছিলাম। না পাইরা পলাইয়া রইলাম। পোলাটারেও কিন্তুক লগে লইতে পারি নাই। বাপধন আমার উঠানে হাঁটতে আছিল। ওরা ঘরবাড়িত আগুন দিল। পোলাটারে ধরল মিলিটারি। টান দিয়া ছিঁড়া ফালাইল। আর সহ্য করতে পারলাম না। চিল্লানি দিয়া উঠলাম!’

 

মা, যে জননী কান্দে

সন্তানের নির্মম মৃত্যুতে যখন পাগলপ্রায় মা ফিরোজা তখন তার ওপর নেমে আসে আরেক বর্বরতা। ‘আমাকে আক (হা) করতেও দেয় নাই। একজন বুকের ওপর পাড়া দিছে। আরেকজন মুখে গামছা ভরে দিছে। আমি আক কইরা চিইক্করও দিতে পারি নাই!’

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলেন পাক হানাদার ক্যাম্পে। সেখানে দিনের পর দিন চলতে থাকে নির্যাতন। বলছিলেন, ‘যখন জ্ঞান হইল দেখলাম চোখ বান্ধা। কই লইয়া আইছে টের পাই নাই। চোখ খোলার পর দেখলাম অনেকগুলা মেয়েমানুষ। কয়েকজন বয়স্কও আছে। তারপর আটকা রইলাম অনেক দিন। অনেক হেস্তনেস্ত করল। কানতে কানতে বুক ভাসাইলাম।’

 

স্বাধীন দেশেও গতি হয়নি

একসময় হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা এসে নিপীড়নে ক্ষতবিক্ষত ফিরোজাসহ আরো অনেককে উদ্ধার করে। দীর্ঘ সেবায় সুস্থ হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রান্নার কাজ করে দিতেন ফিরোজা। একাত্তরের ঝড়ে ওলটপালট হয়েছে যে জীবন, স্বাধীন দেশেও তার কোনো গতি হয়নি। যে মানসিক ও শারীরিক আঘাত বইয়ে গেছে ফিরোজার ওপর দিয়ে তার ক্ষত আজও সারেনি। বরং সমাজের অপবাদে পরিবারে বারবার সমস্যা তৈরি হয়েছে। সংসার ভেঙেছে, নতুন সংসারও টেকেনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে গ্রামে ফেরেন। কিন্তু সমাজের চোখে ‘নষ্টা মেয়ে’ টিকতে পারেননি সেখানে। গ্রামবাসীর চাপে স্বামী তাকে তালাক দেন। আকাশ ভেঙে পড়ে মাথার ওপর। মাটি সরে যায় পায়ের তলা থেকে। তিনি বলেন, ‘একসময় বাড়িত গেছি। টিকতে পারি নাই। মাইনষে নানান কথা কইছে। মাইনষের কথায় টিকতে না পাইরা স্বামীও তালাক দিয়া দিল।’

বিধিবাম

সব হারিয়েও হারতে নারাজ ফিরোজা। গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমালেন ঢাকায়। এ ফুটপাত থেকে সে ফুটপাত, এ বারান্দা থেকে সে বারান্দা। একসময় ঠাঁই হলো শ্যামলীর আদাবরের লালচান মাতব্বরের বস্তিতে। মেসে রান্নার কাজ নিলেন। সেই গল্প বলছিলেন ফিরোজা, ‘পরে একজনের লগে আমার বিয়া হয়। নাম ইসহাক। ভ্যানে সবজি বিক্রি করত। একটা ছেলে আর একটা মেয়েও হইছিল। ছেলেটার নাম জামাল। তিন মাস বাঁইচা আছিল। তারপর খিঁচুনি হইয়া শ্যাষ।’

পরে তিনি চাকরি নিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। মাস্টার রোলে স্পেশাল আয়ার কাজ। নতুন সংসারে স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল। ফিরোজার দুই ভাই মাদারীপুরে থাকে। মেয়েটাকে তাদের কাছে দিয়েছিলেন। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এর মধ্যে একদিন ফিরোজার কানে এলো বড় দুঃসংবাদ—কারওয়ান বাজার থেকে মাল নিয়ে ফেরার পথে স্বামী তার মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়।

 

মেয়ের সংসারে মায়ের বদনাম

সেই বিপর্যয় কাটিয়ে মেয়ে কুলসুমকে বিয়ে দেন ফিরোজা। সাধ্যমতো আয়োজন করেছিলেন বিয়েতে, ‘মাইয়ার বিয়ায় কম করি নাই। যা জমাইছিলাম, সব খরচ করছি। গলার চেইন দিছিলাম আট আনির।’

কিন্তু সেই মেয়ের সংসারেও অশান্তি। বললেন, ‘তয় জামাইটা ভালা পাই নাই। মাইয়াটারে মারত। আজেবাজে কথা কইত। আমারে নিয়াও গালমন্দ করত। মাইয়াটার একবার টাইফয়েড হইছিল। ওষুধপাতি দেয় নাই। উল্টা তালাক দিয়া দিল। পাড়া-প্রতিবেশীরাও কয়—আমি খারাপ, মাইয়া খারাপ।’ বছর দুয়েক পর আবার বিয়ে দিলেন মেয়েটার। সেই সংসারও বেশিদিন টেকেনি। একমাত্র মেয়েটা এখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আয়ার কাজ করে।

 

তার যুদ্ধ অন্তহীন

চিরদুঃখী এই নারী জীবনের পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে। একাত্তরের ঘটনা ‘কলঙ্কের দাগ’ হয়ে যন্ত্রণা দিয়ে গেছে সব সময়। বলতে গেলে জীবনের পুরোটা সময় কেটেছে আর্থিক অনটনে। তবে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়ে। কয়েক বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছেন। ২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে পুরস্কার নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। সে সম্বল নিয়ে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন করে চলা শুরু করেছেন। জীবনভর যাযাবরের মতো কাটানো ফিরোজা বেগম স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছেন ২০২১ সালে। সাভারের হেমায়েতপুরের কান্দি বলিয়ারপুর সরকারি গুচ্ছগ্রামে। সেখানকার মুসলিম ব্লকের এ-৪ ঘরটি তার। দুই রুমের ঘরটির বারান্দায় বাড়তি আর একটা রুম বানিয়ে তাতেই স্বামী পরিত্যক্ত মেয়ে কুলসুম, তিন নাতনি—আফনান, খাদিজা, জান্নাত আর আফনানের স্বামী সোহেলকে নিয়ে থাকবেন।

মেয়েরও স্বামী থেকেও নেই। নাতজামাই সোহেলই তাদের ছেলে অভিভাবক—সব। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘আমি এখন কই যামু। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নির্যাতন করছে। স্বাধীন দেশেও সুখ পাইলাম না। এই কষ্টে কষ্টে দেহটা শেষ কইরা দিলাম। আমার মতন এমন দুঃখিনী করে ওপরওয়ালা যেন কাউরে না পাঠায়।’

সত্তরে পা দেওয়া ফিরোজার যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এখন একমাত্র মেয়েকে আগলে ধরে বেঁচে আছেন। তার একটাই মাত্র চাওয়া—মেয়েটা যেন সন্তানদের নিয়ে সুখে থাকে।

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত