সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ সাহসের বাতিঘর ছিলেন: মাহফুজ উল্লাহ
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। সেরা জীব হিসেবেই মূল্যবোধে উজ্জীবিত থাকবে মানুষ। মানুষের মধ্যে থাকবে মানবিক গুণাবলী। আর পশুর মধ্যে থাকবে পাষবিকতার বৈশিষ্ট এটাই স্বাভাবিক। সদাচারের গুরুত্ব ও তাগিদ দিয়েছে ইসলামসহ পৃথিবীর সকল ধর্ম। মানুষ তার উত্তম ব্যবহার, আচরণ ও উত্তম চরিত্র দ্বারা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে করে আলোকিত। কিন্ত আচার, ব্যবহার, শিষ্টাচার শব্দগুলো বইয়ের পাতায় থাকলেও আমাদের ব্যক্তি জীবনে এর প্রকাশ, ব্যবহার সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন। এসবের অনুপস্থিতিতে এর বিরুপ প্রভাব লক্ষনীয়। আজ সমাজের নানা স্তরে এর ঘাটতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর ফলে দিন দিন অবক্ষয়ের পথে ধাবিত হচ্ছে সমাজ। মানুষের আচরণ নিয়ে, মানুষের অনৈতিক আচরণ নিয়ে আচরণবাদীরা আজ বড়ই উদ্বিগ্ন। সমাজ চিন্তকরা বড়ই হতাশ। মানুষের শিষ্টাচার, আচার- আচরণের মতো অভ্যাসগুলো ছোটকাল থেকেই রপ্ত করতে হয়ে। পারিবারিকভাবে চর্চা করেই লাভ করতে হয়। সমাজ থেকে শিখতে হয়ে।
আচরণবাদীরা বলেন,” শিষ্টাচার হচ্ছে কিছু অভ্যাসের সমষ্টি।” যার হৃদয় যত পবিত্র ও কলুষমুক্ত- তিনি তত কোমল ব্যবহারের অধিকারী হন, তিনি হন সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা অধিকারী। ঠিক সেই ভাবে মাহফুজ উল্লাহর মন, আকর্ষণীয় আচরণের অধিকারী আর কোনো ব্যক্তির আগমন ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে বলে মনে হচ্ছেনা। মাহফুজ উল্লাহ সব সময় হাসিমুখে থাকতেন। সঙ্গী-সাথীদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ামাত্র হাসিমুখে অভ্যর্থনা করতেন, কিন্তু জীবনে কেউ কোনোদিন তাঁকে অট্টহাসি হাসতে দেখেনি। প্রবল হাসির উদ্রেক হলে কখনও কখনও বিদ্যুৎ চমকের মতো একফালি দাঁতের ঔজ্জ্বল্য ফুটে বের হত। তিনি মাহফুজ উল্লাহ মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় হাসিমুখে সম্ভাষণ করেছেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সাক্ষাৎকারীর কথা শুনেছেন। সেই উত্তম ব্যবহার ও আচরণের অধিকারী ছিলেন দেশবরেণ্য প্রতিথযশা সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ ।
বর্তমানে দেশ ও জাতি চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে । এই দু: সময়ে সাহস করে সত্যি উচ্চারণের মতো ব্যক্তিত্বের সংখ্যা হাতেগোনা । সাহসী সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন তাদের অন্যতম একজন । তিনি দেশপ্রেমিকদের জন্য সাহসের বাতিঘর ছিলেন । সাহসী ভূমিকা পালন করে আমাদেরকে উজ্জীবিত করতেন। দেশের এমন দু: সময়ে তাঁর মতো নির্লোভ ও সাহসী মানুষের প্রয়াণ দেশপ্রেমিকদের জন্য তৈরি করেছে গভীর শূন্যতার । মাহফুজ উল্লাহ এক অনন্য চরিত্রের অধিকারী ছিলেন । তিনি সবসময় গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন । প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির এককালের শীর্ষ নেতা মাহফুজ উল্লাহর পেশাগত জীবনে বেঁচে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা । আর তারই হাতেই সূত্রপাত ঘটেছে বাংলাদেশের একমাত্র পরিবেশ সাংবাদিকতার । তার মতো সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন ব্যত্তিত্বেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আজ বর্তমান সময়ে দেশের এই প্রেক্ষাপটে ।
৬৯ বছর বয়সে ২৭ এপ্রিল ২০১৯ চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট অবস্থায় বাংলাদেশ সময় সকাল: ১০ টা ০৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন ।
তাঁহার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ২৭ এপ্রিল ২০২২ উপলক্ষে মাহফুজ উল্লাহ স্মৃতি পরিষদ এর পক্ষ থেকে দুদিনের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে । কর্মসূচির মধ্যে ছিল ২৭ এপ্রিল , বুধবার , খতমে কোরআন তেলাওয়াত, ইফতার ও দোয়া মাহফিল । দ্বিতীয় দিনে এতিম অসহায় দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় ।
প্রিয় বড়ভাই মাহফুজ উল্লাহর সাথে আমার জীবনের পথচলা দীর্ঘ ১০/১১ বছরের । তাঁহার মাধ্যমে আজ আমি একটি অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়েছি । তাঁহার কাছ থেকে যা শিখতে পেরেছি তা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় । যেমন আদর করেছেন ঠিক তেমনি ভাবে শাসন ও করতেন ।
তাঁহার লেখা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই তিনি আমাকে আজীবনের জন্য স্বত্বাধিকার কপিরাইট-হিসেবে দিয়ে গেছেন এই দুটি মহামূল্যবান বইগুলো হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা অর্জন এবং পাহাড় সমান সম্পদের সম্পত্তি দিয়ে গেছেন আমাকে শ্রদ্ধেয় বড়ভাই মাহফুজ উল্লাহ ।১৯৫০ সালের ১০ মার্চ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন দেশের এই খ্যাতিমান সাংবাদিক।
তার পিতার নাম হাবিবুল্লাহ এবং মাতার নাম ফয়জুননিসা বেগম। ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত মুজাফফর আহমেদের দৌহিত্র তিনি।
ছাত্রাবস্থাতেই মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকতা পেশায় নিবেদিত হন। বাংলাদেশের একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্মলগ্ন থেকে কাজ করেছেন মাহফুজ উল্লাহ।
১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দেন মাহফুজ উল্লাহ। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন মাহফুজ উল্লাহ। চীন গণপ্রজাতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে, কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপদূতাবাসে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মাহফুজ উল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন তিনি। ছাত্র রাজনীতির কারণে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন মাহফুজ উল্লাহ।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাহফুজ উল্লাহ।
বাম রাজনীতি দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করলেও বেশ কয়েক বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মাহফুজ উল্লাহ। যে কারণে তার বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসাবেও পরিচিতি রয়েছে।
রেডিও ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি ছিল মাহফুজ উল্লাহর। তাকে উপস্থাপনাও করতে দেখা গেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে একজন সক্রিয় পরিবেশবিদ হিসাবে পরিচিত মাহফুজ উল্লাহ। সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নামক একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহফুজ উল্লাহ।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর করজারভেশন অব নেচারের আন্তর্জাতিক পরিচালনা পর্ষদের প্রথম বাংলাদেশি সদস্য তিনি।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৫০ এর অধিক বই লিখেছেন মাহফুজ উল্লাহ। বইগুলো আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিলাভ করেছে। বইগুলোর অধিকাংশই বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সংগৃহীত আছে।
তার লিখিত বইগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়া: রাজনৈতিক জীবনী, অভ্যুত্থানের ঊনসত্তর, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন: গৌরবের দিনলিপি (১৯৫২-৭১), উলফা অ্যান্ড দ্য ইনসারজেন্সি ইন আসাম, যে কথা বলতে চাই উল্লেখযোগ্য।
মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন একজন সৎ ও আদর্শবান সাংবাদিক। তার সততা ও সাহসিকতা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের সামনে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং শ্রদ্ধাবোধের প্রশ্নে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। মাহফুজ উল্লাহর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, যা সহসাই পূরণ হবার নয়। দেশবরেণ্য সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন তার র্কীতির মাঝে।
অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্ভীকভাবে সত্য বলতেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। এ কারণে সাহসিকতার জন্য তিনি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি হিসেবে মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকতা ও লেখনীর মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন।
‘মাহফুজ উল্লাহ আজ থাকলে আমাদের সাহস দিতে পারতেন। গণতন্ত্রের যাত্রাপথে যে অভিযান সে অভিযানকে শক্তিশালী করতে পারতেন’।
বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে পরিবেশ সাংবাদিকতায় তিনি দেশে পথিকৃৎ ছিলেন।
মৃত্যুর পরেও মাহফুজ উল্লাহ প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন । ‘উনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সাহসকিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। উচিত কথা বলতেন। বর্তমান তরুণ সমাজ ও আগামী নতুন প্রজন্ম মাহফুজ উল্লাহ সম্পর্কে জানা দরকার।’
মাহফুজ উল্লাহ সাহসী সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর পরিবেশ সাংবাদিকতা আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে বুঝতে সহায়তা করেছে। সৎ সাংবাদিকতা, সাহসের সঙ্গে কথা বলা তাঁর গুনের অংশ। লেখা ও কাজের মধ্য তিনি বেঁচে থাকবেন।’
‘যে দেশে মুক্তচিন্তা নেই সেখানেও মাহফুজ উল্লাহ যুক্তি দিয়ে সত্যকে বলার চেষ্টা করছেন। যে সমাজে কথা বলা ছিল কঠিন তিনি সেখানেও যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন। এ দেশে তিনি কথা বলার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।’ ‘মাহফুজ উল্লাহ কোনো দলের অনুগত ছিলেন না। তার পছন্দের দল ছিল, মত ছিল। তিনি একটা ভারসাম্য রেখে কথা বলতেন। মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন ওয়ান ম্যান আর্মি।’ ‘অত্যন্ত সজ্জন একজন ব্যক্তি ছিলেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ ।
‘আজকে আমাদের জাতীর জীবনে যেরকম অন্ধকার নেমে এসেছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে ওইটা মৃত সমাজ। এক্ষেত্রে মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন ব্যতিক্রম। মাহমুজ উল্লাহ ছিলেন সত্য প্রকাশে আপোষহীন।’
‘স্বাধীন সাংবাদিকতা আর নেই। যেখানে ভোটাধিকার থাকে না সেখানে কথা বলার স্বাধীনতা থাকে না। পেশাজীবী আইনজীবী, আর সাংবাদিকরা যদি দলীয় কর্মী না হতেন তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো।’
পরিশেষে তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধেয় বড়ভাই মাহফুজ উল্লাহর জন্য দেশবাসী সহ সকলের নিকট ভাইয়ের জন্য দোয়া চাই । মহান আল্লাহ তায়ালা যেন তাহাকে বিনা হিসেবে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন আমীন আমীন ছূম্মা আমীন
লেখক:-
মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী
স্মৃতি স্বরণীয়: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক বাংলা পোস্ট |√|
প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক মাহফুজ উল্লাহ স্মৃতি পরিষদ |√|
ও প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা |√|
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত