পাথরে লেখিনী নাম ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লেখেছি নাম রয়ে যাবে- তাজ মোহাম্মদ শেখ

| আপডেট :  ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:০১  | প্রকাশিত :  ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:০১

বগুড়া জেলা প্রতিনিধি: একজন মানুষ, একজন ব্যক্তি যিনি জন্ম নিয়েছিলেন অপরের কল্যাণের জন্যে। বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার মথুরাপুরের শান্তিকামী মানুষের নিকট তিনি ছিলেন সবার প্রানের মানুষ। সদাহাস্যজ্বল, প্রখর মেধাবী, সংস্কৃতিমনা, সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা , নিরহঙ্কার এবং মানুষকে আপন করে নেওয়ার কৌশল ছিলো অসাধারণ। কিশোর থেকে যুবক, মধ্যবয়সী থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের অন্তরে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন। সবশ্রেণির মানুষ গর্ব করে বলতেন আমার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল, আমার খুবই আপনজন। সবাই এমন ভাবতেন আমার মত সুসম্পর্ক বুঝি কারও সাথে ছিল না আমি তার সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে কাছের মানুষ। কতটা সবার প্রিয় হলে এই কথা গুলো বলতে পারেন তা তাদের অনুভূতি থেকে বোঝা যায়। গ্রামের অজপাড়া গাঁয়ে জন্মে ছিলেন এই কিংবদন্তি মানব।

আইন শাস্ত্রে পাশ করে প্রথমে সহকারী জজ তারপরে সততা আর দক্ষতার কারণে জেলা ও দায়রাজজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বহুল আলোচিত সন্ত্রাসী খুলনার এরশাদ শিকদারের বিচারকার্যের জন্য আমাদের পাশের বাড়ির মানুষটিকে জাজ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এরশাদ শিকদারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আপনার ওজনের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করা হবে কিন্তু এরশাদ শিকদারকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। সততার মূর্তপ্রতীক আমাদের এই প্রিয় মানুষটি এসব লোভনীয় প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরশাদ শিকদারের মত ভয়ংকর মানুষকে প্রথম ফাঁশির রায় প্রদান করেন। সমগ্র জাতি অবাক বিষ্ময়ে ভাবতে থাকে এমন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে কিভাবে ফাঁশির রায় দিলেন কাজটি সহজ কাজ নয়! তাই সকলের মুখে মুখে প্রশংসা পায় এই জাতীয় বীরের কথা। সেদিন সকল টিভি চ্যানেল ও সকল পত্রিকায় শিরোনাম ছিল আমাদের জজ সাহেবের কথা। পত্রিকা পড়তাম আর দেখতাম শুধু লেখা আছে জেলা ও দায়রা জজ তাজ মোহাম্মদের নাম। গর্বে বুক ভরে যেত আর অন্য জেলার মানুষের সাথে প্রফুল্লচিত্বে গল্প করতাম আমাদের তাজ মোহাম্মদ এরশাদ শিকদারকে ফাঁশির রায় দিয়েছেন। একজন জজ তার কত সীমাবদ্ধতা, কত বাধ্যবাধতা থাকে তা আমরা সকলেই জানি, তারপরও সামাজিক উন্নয়নে তার ছিল অসামান্য অবদান।

জনপ্রতিনিধি না হয়েও যে জনসেবা করা যায় সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। তার জায়গা থেকে রাস্তা, কালভার্ট, ব্রীজ সহ বিদ্যুতায়ন করেছেন, উপকৃত হয়েছি আমরা সবাই। বাসায় আসলে জমি জমার কাগজ নিয়ে তার নিকট যেতাম । ১৯৯২ সাল থেকে বাসায় আসলে ছুটে যেতাম পরামর্শের জন্য। আজ হতে সেই সুযোগটি বন্ধ হয়ে গেল। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা হয়ে আলোকিত করেছেন মথুরাপুর, গোপালনগর, চৌকিবাড়ী ইউনিয়ন বাসীকে এজন্য তাকে স্যালুট জানাই। তিনি যখন পঞ্চগড় জেলার সাবজজ ছিলেন তখন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার। তিনি লক্ষ্য করলেন পঞ্চগড়ে নতুন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার মৌসুম শুরু হয়েছে। জজ সাহেব চিন্তা করলেন আমি আমার এলাকায় কলেজ প্রতিষ্ঠা করে এলাকার মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করব ইনশাআল্লাহ।

স্থানীয় শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। তাই তিনি দীর্ঘদিন কাজের ফাঁকে ফাকে ছুটে আসেন আমাদের মাঝে। এলাকায় এসে সকলকে সাথে নিয়ে গ্রামে গ্রামে খুলিবৈঠক করে সকলকে সুসংগঠিত করেন। বগুড়ায় ক্রয়কৃত নিজের বাড়ি বিক্রি করে সমস্ত অর্থ দান করেন কলেজ প্রতিষ্ঠায়। দক্ষিণ ধুনটের মানুষের একটাই দাবি, একটাই প্রস্তাব কলেজের নামকরণ করা হবে তাজ মোহাম্মাদের নামে। কারণ সে না হলে কলেজ প্রতিষ্ঠা হবেনা, তার স্মৃতি হিসেবে নাম হবে তাজ মোহাম্মদ কলেজ।

সেদিন আমাদের সকলের প্রস্তাব জজ সাহেব প্রতিবাদ স্বরুপ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৪/১২/১৯৯৪ তারিখে (শহীদ বুদ্ধি জীবি দিবস) বুদ্ধিদীপ্ত কাজটি করেন ( Gopal nagorer G, mothura purer M, choukibarir C) G+M+C=GMC College. শুধু নাম করণ-ই প্রত্যাখ্যান করেননি কলেজ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রেজিষ্টার খাতায় তার নাম পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করতে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেছেন, “এই কলেজ তিন ইউনিয়ন বাসীর তাদের নামেই হবে, তারাই এর প্রতিষ্ঠাতা।”

তিনি আরও বলেন, “সবাই যেমন চেষ্টা করেছে আমিও তেমন চেষ্টা করেছি মাত্র। এই মহান মানুষটি গত ৩১/১০/২০২২ তারিখে দক্ষিণ ধুনটের মানুষদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ১/১১/২০২২ তারিখে তার প্রানের প্রতিষ্ঠান জি এম সি কলেজে আনা হয়। সর্বস্তরের মানুষ তাদের প্রিয় মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ৪র্থ বারের মতো জানাজা করে গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। কলেজে হয়তো তোমার নাম বা স্মৃতি চিহ্ন রাখতে দাওনি তাতে আমাদের দুঃখ নেই। তোমার স্থান সবার হৃদয়ে, সবার অন্তরে যা কোন দিন মুছে ফেলা যাবে না। তুমি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে পরম যত্নে কথা দিতে পারি। দোয়া করি আল্লাহ যেন জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান বানিয়ে দেন- আমীন।

লেখক-
মো. গোলাম মোস্তফা (বি.কম) শিক্ষক
মথুরাপুর, ধুনট-বগুড়া।
রচনাঃ ৪ ঠা নভেম্বর -২০২২

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত