রাষ্ট্র সংস্কারে কয়েকটি সাহসী সিদ্ধান্ত, ঘটতে শুরু করেছে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো আজ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর গত ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ড. ইউনূস সরকার। ভঙ্গুর অর্থনীতি ও বিধ্বস্ত একটি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া এই এক মাস বয়সী সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের যথার্থ সময় এখনও হয়নি। তবুও, মাত্র এক মাসেই রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকটি সাহসী সিদ্ধান্তে নতুন করে স্বপ্ন বুনছে প্রায় হতাশ হয়ে পড়া জনগণ। প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে জনআকাঙ্ক্ষার।
রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ড. ইউনূস সেদিন জাতির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সব অপরাধীর বিচার হবে। একথা সব মন্ত্রণালয়, সংস্থা, দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। প্রত্যেকটি অফিসের দায়িত্বরতরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। দেশের সব মানুষকে স্বাধীন, নির্ভয়, নির্ভার থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য ছাত্ররা শহীদ হয়েছেন। তারা গণঅভ্যুত্থান করেছেন। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার সবার। এখানে সবার আকাঙ্ক্ষা পূরণের সরকার থাকবে।’
তরুণ বিপ্লবীরা দেশের মানুষের মনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে, তা পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ড. ইউনূস সরকার গত ২৯ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে। দেশের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতে সই করে বলেছেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’ অন্যদিকে, আইন-শৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্থা সদস্যদের দ্বারা ‘জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে’ গত ২৭ আগস্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে সরকার।
শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তবচিত্র তুলে ধরার লক্ষ্যে শ্বেতপত্র প্রণয়নে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে গত ২৮ আগস্ট ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এছাড়া, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারেও কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা চেয়ে সরকার যোগাযোগও শুরু করেছে।
জুলাই-আগস্ট মাসে গণঅভ্যুত্থানে বল প্রয়োগ ও হতাহতের যে দুঃসহ ঘটনা ঘটানো হয়েছে সেটির স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানকে বাংলাদেশে এসে তাদের তদন্ত শুরু করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তদন্তের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তা পাওয়ার বিধান বাতিল করেছে এ সরকার। গত ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই বৈঠকে বাতিল করা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ।
যাত্রা শুরুর মাত্র এই এক মাসেই দেশের আর্থিক খাত, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে ব্যাপক রদবদলের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে সরকার। গত সাড়ে ১৫ বছরে ভঙ্গুর হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিতর্কিত ও সন্দেহভাজন অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও হিসাব তলবের পাশাপাশি আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে সরকার। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা ছাড়াও অব্যাহতি, পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ পদসমূহেও রদবদল আনা হয়েছে। সরকারের যাত্রাকালে যে পরিস্থিতি ছিল, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে উন্নতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তিনজন উপদেষ্টা গতকাল শনিবার গণভবন পরিদর্শন করেছেন।
পররাষ্ট্রনীতিও স্পষ্ট করেছে সরকার। এবিষয়ে ড. ইউনূস বলেছেন, আমরা সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গত ১৮ আগস্ট ঢাকায় নিযুক্ত বি?ভিন্ন দে?শের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারসহ জাতিসংঘ এবং বি?ভিন্ন সংস্থার আবাসিক প্রধানদের প্রথমবারের মতো ব্রিফিংকালে তিনি বলেছেন, খুব দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু, এই নির্বাচন তখনই হবে, যখন পাঁচটি ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সম্পূর্ণ হবে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের আমূল সংস্কারের মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটা উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হবে।
স্বল্প সময়ে এত কর্মযজ্ঞের মধ্যেই সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে কতগুলো অপ্রত্যাশিত ঘটনা। বিশেষ করে, দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মাথায় সরকারকে মোকাবেরা করতে হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগে সভা-সমাবেশ, দাবি আদায়ে কতিপয় আনসার সদস্যদের সচিবালয়ে ঢুকে অবস্থান নেওয়া এবং গার্মেন্টস ও ওষুধ কারখানাসহ শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষ, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও সরকারকে সামাল দিতে হয়েছে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ড. ইউনূসের সরকার ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও দুই দফায় মতবিনিময় করেছে। এসব মতবিনিময়ে সংস্কারের পরিধি, সংবিধান পুনর্লিখন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময়ে প্রায় সব দলই মৌলিক সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে নিজেদের সম্মতির কথা জানিয়েছে। এছাড়াও ব্যবসায়ী, নারী প্রতিনিধি ও পত্রিকার সম্পাদকসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে ৫ আগস্ট দেওয়া এক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘শহীদদের আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে চাই। এক নতুন যুগের সূচনা করতে চাই। তোমরা (তরুণরা) তোমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ নিয়েছিলে। শহর ও গ্রামীণ জনপদের দেয়ালে আঁকা তোমাদের স্বপ্নগুলো এখনো নানা রঙের সাজ নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এক মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। তা সত্ত্বেও সরকার বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। আমি তরুনদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমরা কখনোই শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।’
এর আগে গত ২৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী- কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা অনুধাবন করছি যে আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গিয়েছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আমি শুধু বলবো, আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত