ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে করণীয়
চলমান মহামারী করোনা আতঙ্কে দেশ ও বিশ্ববাসী। চিকিৎসা সংকট এখনও কাটেনি। এ অবস্থায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ে শুরু হয়েছে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। এক্ষেত্রে বেশি আতঙ্কে আছেন নিম্ন আয়ের কর্মজীবি মানুষ। লকডাউনে ঘরে বসে থাকায় একদিকে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট, অন্যদিকে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার ভয়াবহতা। সবমিলে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় দীন কাটছে সবার। তবে মশক বাহিনীর এ অপতৎপরতা রুখতে প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন।
আসন্ন বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এডিস মশার বংশ বিস্তারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ফুলের টব, টায়ার, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের খালি বোতল, নির্মিত/নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে জমে থাকা পানি ইত্যাদি কারণে এডিস মশার বংশ বিস্তার ঘটে। এডিস মশার বংশ বিস্তারের কারণে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ।
চিকুনগুনিয়া কী: ডেঙ্গু সম্পর্কে এতদিনে সবাই কমবেশি অবগত। কিন্তু এই চিকুনগুনিয়াটা আবার কী? আসুন জেনে নিই সে সম্পর্কে-
চিকুনগুনিয়া মূলত একটি ভাইরাস, যা টোগা ভাইরাস গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। ডেঙ্গুর মতো এটাও মশাবাহিত হওয়ার কারণে একে আরবো ভাইরাসও বলে। ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাস ও এটি একই মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং প্রায় একই রকম রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
বাহক: এডিস ইজিপ্টি ((Ades aegypti) এবং এডিস এলবোপিকটাস (Ades albopictus) মশার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। মশাগুলোকে শরীরের ও পায়ের সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ দেখে সহজেই চেনা যায়। এ মশাগুলো সাধারণত পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে জন্মায় এবং যাদের আশপাশে এ রকম মশা বৃদ্ধির জায়গা আছে, সে সব মানুষেরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
কীভাবে ছড়ায়: প্রাথমিকভাবে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত এডিস ইজিপ্টাই অথবা এডিস এলবোপিকটাস মশার কামড়ের মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। এ ধরনের মশা সাধারণত দিনের বেলা (ভোর বেলা অথবা সন্ধ্যার সময়) কামড়ায়। এছাড়াও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং ল্যাবরেটরীতে নমুনা পরীক্ষার সময়ে অসাবধানতায় এ রোগ ছড়াতে পারে।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধের কোনও টিকা নাই। ব্যক্তিগত সচেতনতাই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। মূলত মশার কামড় থেকে সুরক্ষাই চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায়। শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা রাখা (ফুল হাতা শার্ট এবং ফুল প্যান্ট পরা), জানালায় নেট লাগানো, প্রয়োজন ছাড়া দরজা জানালা খোলা না রাখা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা, শরীরে মশা প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করার মাধ্যমে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায়। শিশু, অসুস্থ রোগী এবং বয়স্কদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
মশার জন্মস্থান ধ্বংস করা: আবাসস্থল ও এর আশপাশে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। বাসার আশপাশে ফেলে রাখা মাটির পাত্র, কলসী, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোলা ইত্যাদি যেসব জায়গায় পানি জমতে পারে, সেখানে এডিস মশা প্রজনন করতে পারে। এসব স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সে ব্যাপারে লক্ষ রাখা এবং নিয়মিত বাড়ির আশপাশে পরিষ্কার করা। সরকারের মশা নিধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা।
যেহেতু এ মশা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত থেকে জীবাণু নিয়ে অন্য মানুষকে আক্রান্ত করে। কাজেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে যাতে মশা কামড়াতে না পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া।
রোগের লক্ষণ সমূহ: (১) হঠাৎ জ্বর আসার সঙ্গে গিঁটে গিঁটে প্রচণ্ড ব্যথা। অন্যান্য লক্ষণ সমূহের মধ্যে- (২) প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, (৩) শরীরে ঠাণ্ডা অনুভূতি (Chill), (৪) বমি বমি ভাব অথবা বমি, (৫) চামড়ায় লালচে দানা (Skin Rash) এবং (৬) মাংসপেশিতে ব্যথা (Muscle Pain)।
সাধারণত রোগটি এমনি এমনিই সেরে যায়, তবে কখনও কখনও গিঁটের ব্যথা কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছরের বেশি সময় থাকতে পারে।
রোগ নির্ণয়: উপরের উপসর্গগুলো কারও মধ্যে দেখা দিলে- ওই ব্যক্তির চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। উপসর্গগুলো শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি (Serology Ges এবং RT-PCR) পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট (আইইডিসিআর)-এ চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের সকল পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা: চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা মূলত উপসর্গ ভিত্তিক। এর কোনও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি ও তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে এবং প্রয়োজনে জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে।
গিটের ব্যথার জন্য গিঁটের ওপরে ঠাণ্ডা পানির স্যাঁক এবং হালকা ব্যায়াম উপকারী হতে পারে। তবে প্রাথমিক উপসর্গ ভালো হওয়ার পর যদি গিঁটের ব্যথা ভালো না হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হবে। কোনও কারণে রোগীর অবস্থা অবনতি হলে দ্রুত নিকটস্থ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।
এসব রোগের প্রাদুর্ভাব রোধকল্পে প্রয়োজনীয় সতর্কতা-
১. নির্মাণাধীন ভবনের কিউরিং চলাকালীন সময়ে পানি জমিয়ে না রেখে ২ (দুই) দিন পরপর পানি পরিবর্তন করুন,
২. নির্মিত/নির্মাণাধীন ভবন এবং এর আশেপাশের চৌবাচ্চার পানি পরিবর্তন করুন,
৩. সরকারি ব্যবস্থাপনায়/ডেভেলপার/সমবায়/মালিক কর্তৃক নির্মিত/নির্মাণাধীন ভবনের ভিতরে ও বাহিরে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
এছাড়াও এডিস মশা নিধন এবং ডেঙ্গু মোকাবেলায় করণীয়-
১. মশার উৎপত্তিস্থল যেমন- শহরের খাল, নালা, দুই বাড়ির মধ্যবর্তী অপরিচ্ছনন্ন স্থান, কাঁচা বাজার, সরকারি অফিস ও আবাসিক স্থাপনা জরুরি ভিত্তিতে পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
২. এডিস মশার বিস্তাররোধে অফিস ছুটিকালীন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের টয়লেটের কমোড অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে।
৩. নির্মাণাধীন ভবন এবং যেসব সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নিজ উদ্যোগে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবে না বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার অভাবে লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া যাবে সেসব ব্যক্তি ও স্থাপনার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী বার বার জরিমানা করতে হবে।
৪. প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে পরিচ্ছন্নতা অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রতি ওয়ার্ডে সাব-কমিটি গঠন করে তাতে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ২০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে অর্ন্তভূক্ত করে সামাজিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করতে হবে।
৫. মশকনিধন এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতের স্বার্থে মন্ত্রণালয়, সব সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। সিটি করপোরেশনগুলো আগামী সাত দিনের মধ্যে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে।
৬. সম্ভাব্য ডেঙ্গু মোকাবেলায় সম্মিলিত উদ্যোগ হিসেবে এলজিআরডি মন্ত্রীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হবে। ডেঙ্গু মোকাবেলায় প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের করণীয় নির্ধারণ করে মন্ত্রীর স্বাক্ষরে একটি আধা-সরকারিপত্র পাঠানো হবে।
৭. কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একাধিক উদ্যোক্তা ও আমদানীকারককে কীটনাশক আমদানীর সুযোগ দিলে তা বাজারে সহজলভ্য হবে। এর ফলে মানুষ নিজ উদ্যোগে হস্তচালিত মেশিন দিয়ে নিজের আঙ্গিনার মশক নিধন করতে পারবে।
৮. সম্মিলিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে দুই সিটি করপোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ একযোগে মশক নিধন অভিযান শুরু করবেন। স্থানীয় সরকার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেবে।
৯. ঢাকার খাল ও নালাগুলো একযোগে পরিচ্ছন্ন করার স্বার্থে এবং স্থাপনাগুলো পরিচ্ছন্ন করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত বিভাগ, রাজউক এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিতে হবে।
১০. বর্তমানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দীর্ঘমেয়াদী ছুটির কারণে জনসাধারণ ও যানবাহনের চাপ কম আছে। এই সময় পুরো ঢাকা শহরকে শতভাগ পরিস্কার করার সুযোগ সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত