যে কারণে সালমান রুশদিকে নিয়ে এত ক্ষোভ
১৯৮৮ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক ব্রিটিশ সালমান রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি প্রকাশিত হয়। তবে বই প্রতি প্রকাশিত হওয়ার আগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ লেখক বোধহয় ভাবতেও পারেননি যে বাক প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নেমে আসতে পারে লাগামহীন ক্ষোভের খড়গ।
‘স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর পর সালমান রুশদি নিজেও সেই কথা স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, আমি আশা করেছিলাম কয়েকজন মোল্লা অসন্তুষ্ট হবে, আমাকে গালিগালাজ করবে। পরবর্তীতে আমি জনসম্মুখে নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে পারব।
কিন্তু বিজ্ঞাপনের কপি রাইটার হিসেবে জীবন শুরু করা রুশদি যখন ক্রিম কেকের বিজ্ঞাপনের ‘দুষ্টু কিন্তু মিষ্টি’র মতো শ্লোগান লিখতেন তখন ভুলেও ভাবেননি ক্ষোভের সুনামি তার বাকি জীবনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি যে একটি ভূ-রাজনৈতিক বুবি ট্র্যাপে পরিণত হতে চলেছেন, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না।
কিন্তু ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশিত হওয়ার পর বদলে যায় লেখক রুশদির জীবন।
পরাবাস্তববাদী উত্তরাধুনিক এই বইটি নিয়ে মুসলিম অনেকের মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র ক্ষোভের। বইটিতে ধর্ম অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করে অনেকেই।
বইটির পর ওপর খড়গ নেমে আসে সালমানের নিজের জন্মভূমি ভারতেই। ভারতই প্রথম এই বইটি নিষিদ্ধ করে। পরে পাকিস্তানসহ অন্য বেশ কিছু মুসলিম দেশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও একই পদক্ষেপ নেয়।
অবশ্য ক্ষোভের পাশাপাশি উপন্যাসটির প্রশংসাও করেছেন অনেকে। দ্য হুইটব্রেড প্রাইজও জিতে নেয় দ্য স্যাটানিক ভার্সেস। কিন্তু দু মাসের মধ্যেই বইটিকে ঘিরে দানা বাঁধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ।
১৯৮৮ সালের অক্টোবরের মধ্যেই লাগাতার মৃত্যুর হুমকি পেয়ে দেহরক্ষী নিয়োগ দেন রুশদি। সব ভ্রমণ বাতিল করে নিজেকে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
ওই বছরের ডিসেম্বরে হাজার হাজার মুসলিম গ্রেটার ম্যানচেস্টারের বোল্টনে বিক্ষোভ করে দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের অনেকগুলো কপি পুড়িয়ে দেয়। বইটি নিয়ে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের মার্কিন কালচারাল সেন্টারে উত্তেজিত জনতা হামলা চালালে ছয়জন নিহত হয়। বিক্ষোভ হয় শ্রীনগর ও কাশ্মিরেও।
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় উপমহাদেশে রুশদি বিরোধী দাঙ্গায় অনেকে নিহত হন। তেহরানে ব্রিটিশ দূতাবাসে পাথর ছোড়া হয় আর রুশদির মাথার দাম ঘোষণা করা হয় তিন মিলিয়ন ডলার।
দাঙ্গায় বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির পর ১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা খোমেনি একটি ফতোয়া জারি করেন। ওই ফতোয়ায় শুধু রুশদি নন, বইটি প্রকাশের সঙ্গে জড়িত সবার মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়। ওই ইস্যুতে ইরান ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্কও ছিন্ন করে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে কিছু মুসলিম নেতা লেখা পরিবর্তনের আহ্বান করলেও আরেকটি অংশ খোমেনিকে সমর্থন করে।
রুশদি ইতোমধ্যেই স্ত্রীসহ পুলিশি নিরাপত্তার অধীনে আত্মগোপনে চলে যান এবং মুসলিমদের ক্ষোভের কারণ হওয়ায় দুঃখও প্রকাশ করেন।
কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেনি তার ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
বইটির প্রকাশনা সংস্থা ভাইকিং পেঙ্গুইনের লন্ডন অফিসে ইট পাটকেল ছোড়া হয় আর নিউইয়র্ক অফিসে পৌঁছায় মৃত্যু হুমকি।
তবে এর মধ্যেই বইটি আটলান্টিকের দুই পাড়েই বেস্ট সেলারের তালিকায় চলে যায়। উগ্রপন্থী মুসলিমদের বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় তেহরান থেকে অনেক দেশ রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠায়।
কিন্তু শুধু সালমান রুশদিই নয় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই দিতে হয়েছে চড়া মূল্য।
১৯৯১ সালের জুলাইতে স্যাটানিক ভার্সেসের জাপানি অনুবাদককে টোকিওতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কয়েক দফায় ছুরিকাঘাত করে তাকে তার অফিসের বাইরে ফেলে রাখা হয়েছিল।
এর আগে সেই মাসেই ইটালিয়ান অনুবাদককে তার অ্যাপার্টমেন্টেই ছুরিকাঘাত করা হয়। যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৯৭ সালে সংস্কারপন্থী ইরানি পশ্চিমা বিশ্ব ও ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট সাইয়িদ মোহাম্মদ খাতামি আর সক্রিয়ভাবে রুশদির উপর ফতোয়া কার্যকর করার চেষ্টা করবেন না বা তাকে হত্যা করার জন্য কাউকে উৎসাহিত করবেন না বলে ইঙ্গিত দেন।
২০০১ সাল থেকে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন রুশদি।
আরও পড়ুন
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত