খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা নিয়ে নতুন হিসাব-নিকাশ

| আপডেট :  ১০ মে ২০২১, ০৮:১৮  | প্রকাশিত :  ১০ মে ২০২১, ০৮:১৮

উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার আবেদন আইনি বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে ‘না’ করে দেওয়া হলেও এর সম্ভাবনা নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। তার উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে আবারও পারিবারিকভাবে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগের উপায় খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি বন্দি অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ ও জামিনের আইনি আরও কোনও পথ আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখছে বিএনপি।

খালেদা জিয়ার পরিবারের একাধিক সূত্র, বিএনপির প্রভাবশালী একাধিক দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পরই খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার আবেদন করেছিলেন। ‘তৃতীয়’ একটি পক্ষের মাধ্যমে পরিবার ও সরকারের মধ্যে ‘নেগোসিয়েশন’র অগ্রগতি হলেও শেষ মুহূর্তে তা বাস্তব হয়নি।

বিএনপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জানিয়েছেন, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনও উন্নতি নেই। অক্সিজেন ব্যবহার কমলেও পোস্ট-কোভিড নানা জটিলতা রয়েছে তার। সেক্ষেত্রে তার মনমতো চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেওয়াই যুক্তিসম্মত। তাদের ভাষ্য, ব্রিটিশ ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগেও বন্দি অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। আর খালেদা জিয়ার শারীরিক যে অবস্থা, তাতে যেকোনও সময় পরিস্থিতি খারাপ দিকে যেতে পারে। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা মনে করছেন, খালেদা জিয়া দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হলেও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।

গত ৩ মে খালেদা জিয়ার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিলে সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুদিন পর ৫ মে রাত সাড়ে আটটার দিকে খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমণ্ডির বাসায় লিখিত চিঠি নিয়ে যান তার ভাই শামীম এস্কান্দার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দুজনেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আবেদনটি সরকার ইতিবাচকভাবেই বিবেচনা করবে। যদিও গতকাল রবিবার (৯ মে) তারা দুজনেই জানান, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ নেই। পরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল জানান, তার দল সরকারের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তার দাবি, যে ধারায় খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়েছে সে ধারাতেই তাকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগের বিষয়টিও আছে।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার লক্ষ্মণ বিবেচনা করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল। একইসঙ্গে দুদিন পর শামীম ইস্কান্দার আবেদন নিয়ে যান। ওই সময় পর্যন্ত সবকিছু ইতিবাচকভাবে সামনে আসলেও রবিবার (১০ মে) অসম্মতি জানায় সরকার। সূত্রের দাবি, ‘তৃতীয়’ একটি পক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে বেগম জিয়ার বিদেশযাত্রা নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের একটি পক্ষ বেগম জিয়াকে বিদেশে যেতে দিতে নারাজ। বিশেষ করে, তার রাজনৈতিক অবস্থান ও সামনের দিনের উদ্ভূত পরিস্থিতির শঙ্কা থেকে প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সূত্রের আরও দাবি, বিএনপির অভ্যন্তরেও একটি পক্ষ বেগম জিয়ার বিদেশ যাওয়ার বিপক্ষে কাজ করছে। তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ একটি পক্ষ চাইছে, তাকে বিদেশ না পাঠাতে। আর এই পক্ষটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, দলের নেতাদের কেউ-কেউ। তবে তারেক রহমান নিজেই পুরো বিষয়টি দেখভাল করায় বিভ্রান্তির সুযোগ কম বলেও জানায় সূত্রটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘সরকার ইতিবাচকভাবে বেগম জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যেতে দেবেন বলেই জানতাম। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, তাতে ভিন্ন একটি শক্তির পক্ষ থেকে সরকারকে বুঝানো হয়েছে সম্ভবত—তাকে বিদেশ যেতে না দেওয়ার জন্য। কিন্তু এটাই সত্যি, যে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা যে পর্যায়ে বিদ্যমান, সেখান থেকে তার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘সরকার খালেদা জিয়া, তারেক রহমানকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। তাদের জনপ্রিয়তা একটা বড় কারণ। তবে ম্যাডামকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার জন্য সব পথ এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি।’

বিএনপির সিনিয়র একাধিক আইনজীবী মনে করছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়ার আরও একাধিক উপায় আছে। তবে সবগুলোই সরকারের অনুমতির ওপর নির্ভরশীল। একটি হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টে রিট করা। প্রধান বিচারপতি চাইলে সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্যারোলের (রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বিশেষ কারণে শর্তাধীনে নিদিষ্ট সময়ের জন্য মুক্তি প্রদান করা) আবেদন করা। এক্ষেত্রে দলের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের একাধিক নেতাকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা গেলে অগ্রগতি আসতে পারে, এমন সম্ভাবনাও জানান অভিজ্ঞ একাধিক আইনজীবী।

রবিবার (৯ মে) রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে  বলেন, ‘কী করতে হবে, এটা ম্যাডামের পরিবারই ভালো জানেন, তারাই ঠিক করবেন।’ তবে চেয়ারপারসন কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একজন বলেন, ‘বেগম জিয়ার সম্মানহানি না করে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়— সেগুলোতে তিনি মত দেবেন, আশা করা যায়।’

বন্দি অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ

বিএনপি নেতাদের বাইরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা বেগম জিয়াকে চিকিৎসার স্বার্থে বিদেশে পাঠানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, দেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতাদের বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের অনুমতি দেওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা আছে।

সোমবার (১০ মে) দুপুরে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগে থেকেই অনেক অসুস্থ। এখন তিনি করোনা-পরবর্তী শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। সেক্ষেত্রে তাকে তার পরিবারের দাবি অনুযায়ী, বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া একটি ন্যুনতম মানবিক দাবি। আর একইসঙ্গে সুস্থতার জন্য চিকিৎসাগ্রহণ একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক অধিকারও বটে। সরকার চাইলে তার জামিনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তাকে তার স্বাধীনভাবে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দিতে পারে। না হলে এটা অন্যায় হবে। পরবর্তীতে যেকোনও পরিস্থিতির দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।’

আসম আবদুর রবের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি জানান, ১৯৭৯ সালের ১ মে আসম আবদুর রবকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছিল জিয়াউর রহমানের সরকার। ওই সময় তার শারীরিক অবস্থা ছিল গুরুতর। কানে প্রায় শুনতে পেতেন না, স্পাইরাল কডে ছিল ইনফেকশনজনিত ব্যাথাও। ওই সময় তৎকালীন সরকার রবের সঙ্গে একজন পুলিশ ও একজন চিকিৎসককে সঙ্গে পাঠিয়েছিল।

‘আ স ম আবদুর রব— রাজপথ থেকে সংসদ’ শীর্ষক গ্রন্থে ‘বন্দী অবস্থায় পশ্চিম জার্মানিতে রব শীর্ষক’ নিবন্ধে সুভাষ সাহা উল্লেখ করেন, ‘তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমজীবী-পেশাজীবী সংগঠন, সমিতি এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে জনাব রবকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠায়।’

২০০৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিমকেও গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছিল। ওই সময় মোহাম্মদ নাসিমের বিদেশযাত্রার পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন তার ছেলে তানভীর শাকিল জয়।

জানতে চাইলে সোমবার বিকালে সিরাজগঞ্জ-১ আসনের এমপি তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘আব্বা ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে স্ট্রোক করলেন, আর আমরা ২০০৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে তাকে জামিনে সিঙ্গাপুর নিতে পেরেছিলাম।’

সেই সময় অবৈধভাবে এক কোটি ২৬ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন ও ২০ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত ২০০৭ সালে মোহাম্মদ নাসিমকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে ২০১০ সালে উচ্চ আদালত ওই সাজা ও মামলা বাতিল করে দেন।

ব্রিটিশ ভারত সরকারের সময়েও ত্রিশের দশকে মহাত্মা গান্ধীও জেল থেকে চিকিৎসার কথা বলে জামিন নিয়েছিলেন, বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী একজন সদস্য বলেন, ‘মনে হয় না সহজেই বেগম জিয়াকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেবে সরকার। যদি শেষ মুহূর্তে কোনও সমস্যা দেখতে পায়, তাহলে তারা দিতে পারে। বিশেষ করে সরকার-প্রধান মানবিক কারণ দেখিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারেন।’

সরকারের প্রভাবশালী একটি সংস্থার সূত্র বলছে, বেগম জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি সরকারের ওপরমহল থেকে নিয়মিত খোঁজ রাখা হচ্ছে। তার সুচিকিৎসার জন্য আন্তরিকতাও আছে। ফলে, তার কন্ডিশনের ওপর নির্ভর করে সরকারের পক্ষ থেকে যেকোনও সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বাইরে নেওয়া হলেও তার পরিস্থিতির ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ রাখবে সরকার। তবে খালেদা জিয়াকে কোন দেশে নেওয়া হবে, এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে পরিবারের চাওয়ার সমন্বয় থাকতে হবে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে সংস্থার সূত্রটি।

গত ২৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। ১৪ দিন ধরে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন। রবিবার রাতে মির্জা ফখরুল জানান, তিনি অক্সিজেন ছাড়াই শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন।

 

আরও পড়ুন


  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত